রেমিট্যান্স প্রবাহ ফের ঊর্ধ্বমুখী

রেমিট্যান্স প্রবাহে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় বছর শুরু হলেও পরের মাস ফেব্রুয়ারিতেই সেভানে ধস নামে। ওই মাসে ২১ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স আসে। এর এক মাস পরেই আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায় রেমিট্যান্স প্রবাহে।

অর্থাৎ সদ্য সমাপ্ত মার্চ মাসে প্রবাসী বাঙালিরা মোট ১৮৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। যা দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার সমান ৮৬ টাকা হিসাবে) ১৫ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। যা আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারি কাটিয়ে পৃথিবীর সব দেশেই ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন বহির্বিশ্বের সঙ্গে যাতায়াত বেড়েছে। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলের চাহিদা বেড়েছে। তাছাড়া পবিত্র রমজান উপলক্ষে প্রবাসীরা তাদের জমানো টাকা পরিবারের জন্য পাঠিয়েছেন। ফলে চলতি অর্থবছরের মার্চে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হওয়ায় ওই সব দেশ থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসছে বলে মনে করছেন তারা। আগামীতে ঈদকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বাড়বে বলেই আশা প্রকাশ করছেন তারা।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম অর্থসূচককে বলেন, ‘চলতি বছরের শুরুতেই রেমিট্যান্সে প্রণোদনার হার বাড়িয়েছে সরকার। যার প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সে। সামনে দুটি ঈদ উৎসব আছে। সবকিছু মিলিয়ে আগামী দিনগুলোয় রেমিট্যান্স বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের প্রথম দিন থেকেই সরকার রেমিট্যান্স প্রবাহে নগদ প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, টানা পাঁচ মাস কমার পর ডিসেম্বরে কিছুটা বেড়েছিল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সেই বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ (১.৭০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

যদিও এর পরের মাসেই কমে যায় রেমিট্যান্সের গতি। ফলে ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স আসে ১৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর পরের মাসেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। অর্থাৎ মার্চ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮৬ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১৫ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় মার্চে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মার্চে রেমিট্যান্স কিছুটা কমেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ৫ কোটি ডলার। ২০২১ সালের মার্চে ১৯১ কোটি ১৬ লাখ ডলার পঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

এর আগে, ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ার সময় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল মহামারি। আশঙ্কা করা হয়েছিল, প্রবাসী আয়ে ভাটা পড়বে। কিন্তু অবিশ্বাস্য উত্থানে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে চাপ পড়তে দেননি। টানা দেড় বছর বাড়ার পর গত বছরের জুলাই থেকে ক্রগামত কমতে থাকে রেমিট্যান্স। তবে বছরের শেষ পাঁচ মাস ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির পরও ২০২১ সালে ২ হাজার ২০৭ কোটি (২২.০৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ।

এর আগে এক বছরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালে, ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে এসেছিল ১৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।

অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ১ হাজার ১৯৪ কোটি ৪০ লাখ (১১.৯৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ২৯৪ কোটি ডলার। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।

২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর রেমিট্যান্স প্রবাহেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ওই বছরের এপ্রিলে মাত্র ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। মে মাসে তা বেড়ে ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ ডলারে ওঠে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার।

মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরোটা সময়ে (২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন লক্ষ করা যায়। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটার টান লক্ষ করা যায়। প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৮১ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৭২ কোটি ৬২ লাখ ডলার। অক্টোবরে আসে ১৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। নভেম্বরে আসে আরও কম, ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। তবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে তা কিছুটা বেড়ে ১৬৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। সর্বশেষ জানুয়ারিতে এসেছে ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.