জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমান কোথায় আছেন তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। ছেলের ছাগলকাণ্ডের পর থেকে তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ঈদের ছুটি শেষে একদিনও অফিস করেননি তিনি। আবার অফিস থেকে ছুটিও নেননি। তার মোবাইল ফোন নাম্বারটিও বন্ধ আছে। এ অবস্থায় আবার গুজব ছড়িয়েছে, মতিউর দেশে নেই। তিনি গোপনে অন্য কোনো পাসপোর্টে দেশ ছেড়েছেন। তবে আদৌ তিনি বিদেশে পালিয়েছেন কি না সে সম্পর্কে কেউ কিছু নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।
এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান শুরুর পর সপরিবারে গোপনে দেশ ছেড়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। একইভাবে ছাগলকাণ্ড ও দুদকের নড়চড়ার পর মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী ও তাঁর ছেলে ছাগলকাণ্ডের হোতা মুশফিকুর রহমান ইফাত দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন। তাই মতিউরের দেশ ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে। অবশ্য এর আগেও একবার গুজব ছড়িয়েছিল, এনবিআরের এক সময়ের প্রতাপশালী কর্মকর্তা মতিউর মাথা ন্যাড়া করে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারত পালিয়ে গেছেন। তবে পরে একাধিক সূত্রে জানা যায়, তিনি দেশেই আছেন। আখাউড়া স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ দাবি করে, মতিউর তার পাসপোর্ট (ই-০০০১১৬৫২) ব্যবহার করে এই বন্দর দিয়ে দেশের বাইরে গেছেন, এমন কোনো তথ্য নেই।
তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, দেশের বেশ কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের একাধিক পাসপোর্ট রয়েছে। তারা গোপনে বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে রেখেছেন, যাতে বিশেষ প্রয়োজন দেশ থেকে পালাতে পারেন। তাই মতিউরেরও অন্যদেশের পাসপোর্ট থেকে থাকতে পারে। আর ওই পাসপোর্ট দিয়ে তিনি দেশ ছেড়ে গিয়ে থাকতে পারেন। মতিউরের প্রথম প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকীর মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতা কানাডার নাগরিক। তিনি স্বামীসহ সে দেশে বসবাস করেন। অন্যদিকে মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী এবং তার সন্তানদেরও বিদেশী নাগরিকত্ব রয়েছে, যে কারণে ছাগলকাণ্ডের পর শিবলী ও ইফাত দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছেন। তাই মতিউরেরও অন্য দেশের পাসপোর্ট থাকার অনেক সম্ভাবনা আছে।
তাছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে মতিউরের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে বলে নানা সূত্রে জানা গেছে। আর ওই বিনিয়োগের দেখভাল করে থাকেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলীর ভাই ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক হত্যার মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত পলাতক আসামী আবিদুল ইসলাম আবিদ। তাই মতিউরের দুবাইয়ের রেসিডেন্সি পারমিটও থেকে থাকতে পারে।
ঈদ-উল-আজহার আগে মতিউরের দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে ইফাত ১২ লাখ টাকায় একটি ছাগল বুকিং দিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। আর এর সূত্র ধরে একে একে বের হয়ে আসতে থাকে বাবা মতিউর রহমানের লাগামহীন দুর্নীতি ও বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য। এর প্রেক্ষিতে গত ২৩ জুন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে প্রত্যাহার করে তাঁকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করে সরকার। পরদিন সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। এর পর ২৫ জুন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ চিঠি দিয়ে মতিউরকে ওই দিনের একটি মিটিংয়ে সশরীরে থাকার নির্দেশ দেয়। কিন্তু মিটিং দূরে থাক, নতুন কর্মস্থলে এখন পর্যন্ত একদিনও অফিস করেননি মতিউর।
জানা গেছে, নতুন কর্মস্থলে বদলীর পর অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আরেকজনের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে যোগদানপত্র জমা দেন মতিউর রহমান। কিন্তু এর পর একদিনের জন্যেও নতুন কর্মস্থলে উপস্থিত হননি তিনি। এমনকি কোনো ছুটিও নেননি।
কোনো একটা বিপদের আঁচ করতে পেরে গত মাসের মাঝামাঝি তড়িঘড়ি করে ব্যাংক থেকে ৮ কোটি টাকা তুলে নেন মতিউর রহমান। বর্তমানে জমা আছে ৪ কোটি টাকা। টাকা লেনদেনে বিভিন্ন সময় ১১৫টি ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেছেন মতিউর।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), সিআইডির মানি লন্ডারিং ইউনিটসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মতিউরের অর্থ লেনদেনের তথ্য বের করতে অনুসন্ধান শুরু করেছে। তাঁর বিদেশি পাসপোর্ট রয়েছে কিনা, তাও তদন্ত করছে।
জানা যায়, নিজের নামে অঢেল সম্পদের পাশাপাশি মতিউর স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়দের নামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, নরসিংদী, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে আছে এফডিআর এবং পুঁজিবাজারে শতকোটি টাকার বিনিয়োগ।
আলোচিত ছেলে ইফাতকেও কিনে দিয়েছেন বিলাসবহুল গাড়ি। বসুন্ধরায় আছে বাড়ি। গুলশানের সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে ৮৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর প্লটে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। দ্বিতীয় স্ত্রী থাকেন লালমাটিয়ার ৮ নম্বর রোডের ৪১/২ ইম্পেরিয়াল ভবনে। কাকরাইলেও ফ্ল্যাট রয়েছে। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামে ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাক্সেসরিজ কারখানা আছে মতিউরের। যদিও কাগজে-কলমে কারখানার মালিক তাঁর ভাই এম এ কাইয়ুম হাওলাদার।
ময়মনসিংহের ভালুকায় ৩০০ বিঘা জমিতে এবং বরিশালে গ্লোবাল শুজ নামে দুটি জুতা তৈরির কারখানা আছে। নরসিংদীর রায়পুরায় ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট রয়েছে। এসব রিসোর্টের মালিকানায় আছে তাঁর ছেলে ও মেয়ে। মতিউর পূর্বাচলে আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পটেরও মালিক।
ঘুষ-দুর্নীতির পাশাপাশি শেয়ারবাজারে কারসাজির মাধ্যমে মতিউর কয়েকশত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন বলে জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্বল কোম্পানির শেয়ার প্লেসমেন্ট নিয়ে নানা কারসাজি করে সেগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য ভাল দেখিয়ে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তালিকাভুক্ত একাধিক কোম্পানির শেয়ার কারসাজির অভিযোগও আছে। একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া মতিউরের এক সাক্ষাতকারে বিষয়টির স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.