তামাক থেকে রাজস্ব বাড়বে ১০ হাজার কোটি টাকা

তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ প্রাণহানি ঘটছে। বিভিন্ন স্তরের সিগারেটের দশ-শলাকার প্যাকেটের খুচরা মূল্য বৃদ্ধি ও এগুলোর ওপর কার্যকর করারোপের প্রস্তাব দিয়েছে উন্নয়ন সমন্বয়। এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে সিগারেট বিক্রি থেকে সরকারের রাজস্ব বাড়বে ১০ হাজার কোটি টাকা, যা আগের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি।

রোববার (১০ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সিগারেটের ওপর কার্যকর করারোপের প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে কর প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।

এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ, সিটিএফকের লিড পলিসি এ্যাডভাইজার মো. মোস্তফিজুর রহমান, ইউসিএসআই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা এবং ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন ড. গোলাম আহমেদ ফারুকী, বুয়েটের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলাম এবং বিআইডিএসের গবেষণা সহযোগী হোমায়রা আহমেদ। 

লিখিত বক্তব্যে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারি দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এদেশে ১৫ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সী নাগরিকদের মধ্যে ১৮ শতাংশ ধূমপান করেন। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ প্রাণহানি ঘটছে। ২০১৮ সালে এসব রোগে বাংলাদেশে ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। ঐ বছর তামাক ব্যবহারজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর তামাক পণ্য বিক্রি থেকে ঐ বছর যে রাজস্ব এসেছে প্রায় ২২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা এই অর্থনৈতিক ক্ষতির ৭৫ শতাংশেরও কম। ফলে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির তুলনায় এসব ক্ষতিকারক পণ্য বিক্রি থেকে আসা রাজস্বের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম। অর্থনৈতিক ক্ষতির সঙ্গে অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি যোগ করলে এ পার্থক্য আরও বাড়বে।

এসময় আরও বলা হয়, সিগারেট ব্যবহারের এই ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০-এর মধ্যে ‘তামাক ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে বাংলাদেশে ‘তামাকজাত পণ্যের ক্রয়ক্ষমতা কমানোর নির্দেশনা দিয়েছেন।’ এই প্রেক্ষাপটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিভিন্ন স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন তামাক-বিরোধী নাগরিক সংগঠন এবং দেশী- বিদেশী গবেষকরা।

প্রস্তাবনায় বলা হয়, নিম্ন স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা থেকে ৬০ টাকা করা হোক। সম্পুরক শুদ্ধ হার ৫৮ শতাংশ থেকে ৬৩ শতাংশ করা দরকার। এর ফলে প্রাপ্য সম্পূরক শুল্ক ২৬ টাকা ১০ পয়সা থেকে বেড়ে ৩৭ টাকা ৮০ পয়সা হবে। প্রাপ্য মোট কর ৩৩ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বেড়ে ৪৭ টাকা ৪০ পয়সা হবে।

এছাড়া মধ্যম স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য ৬৭ টাকা থেকে ৮০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। সংগঠনটি জানায়, মধ্যম স্তরের সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক হার আগের মতো ৬৫ শতাংশ রাখা হোক। খুচরা মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রাপ্য সম্পূরক শুল্ক ৪৩ দশমিক ৫৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫২ টাকা হবে। এর ফলে প্রাপ্য মোট কর ৫৪ টাকা ২৭ পয়সা থেকে বেডে ৬৪ টাকা ৮০ পয়সা হবে।

অপরদিকে উচ্চ স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য ১১৩ টাকা থেকে ১৩০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে উন্নয়ন সমন্বয়। উন্নয়ন সমন্বয়ের প্রস্তাবে বলা হয়, সম্পূরক শুল্ক হার আগের মতো ৬৫ শতাংশ রাখা হোক। খুচরা মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রাপ্য সম্পূরক শুল্ক ৭৩ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা হবে। আর প্রাপ্য মোট কর ৯১ টাকা ৫৩ পয়সা থেকে বেড়ে ১০৫ টাকা ৩০ পয়সা হবে।

উন্নয়ন সমন্বয়ের প্রস্তাবে আরও বলা হয়, প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা করা হোক। সম্পূরক শুল্ক হার আগের মতো ৬৫ শতাংশ রাখা হোক। খুচরা মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রাপ্য সম্পূরক শুল্ক ৯৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা হবে। আর প্রাপ্য মোট কর ১২১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বেড়ে ১৩৭ টাকা ৭০ পয়সা হবে।

সংগঠনটি জানায়, এই প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হলে সিগারেট ব্যবহারের হার ১৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ হবে। পাশাপাশি ১৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান ছাড়বেন এবং ১০ লক্ষ তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবেন। আর দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ১১ লক্ষ অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।

সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি এবং মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সিগারেটের দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাবনা দাঁড় করানো হয়েছে। এতে একদিকে সিগারেট ব্যবহারের হার যেমন কমবে, অন্যদিকে সিগারেট থেকে আসা সরকারের রাজস্বেও কোন চাপ পড়বে না। তাই এই প্রস্তাবনাকে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার পথে একটি ব্যয়-সাশ্রয়ী পদক্ষেপ বলা যায় বলেও জানায় উন্নয়ন সমন্বয়ের সংশ্লিষ্টরা।

অর্থসূচক/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.