বাংলাদেশের ‘টুয়েলভথ ফেল’ সাদিকুর এখন বিসিএস ক্যাডার, পাশে ছিলেন স্ত্রী

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি চর্চিত সিনেমা ‘টুয়েলভথ ফেল’। অনুরাগ পাঠকের একটি উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি ওই সিনেমায় দেখানো হয়েছে, মনোজ কুমার কিভাবে চরম দারিদ্রতা কাটিয়ে একজন ভারতীয় পুলিশ সার্ভিস (আইপিএস) অফিসার হয়েছেন। মনোজ টুয়েলভথ ক্লাসে ফেল করেছিলেন। সিনেমাতে তার পাশে থেকে অনুপ্রেরণা জোগাতে দেখা যায় প্রেমিকা শ্রদ্ধাকে।

দোকানের সেলসম্যান ও গার্মেন্টকর্মী থেকে ৪৩তম বিসিএসএ শিক্ষা ক্যাডার সুপারিশপ্রাপ্ত সাদিকুর রহমানের। যার বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার সাখুয়া ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামে। সাদিকুরও এইচএসসিতে ফেল করেন। তার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পেছনে অন্যতম অবদান রয়েছে স্ত্রী আফসানা মিমির।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন নিশ্চিত ফেল ধরে নিয়েই ব্যাগ গুছিয়ে বাবাকে ফাঁকি দিয়ে গার্মেন্টসে পাড়ি জমায় সাদিকুর রহমান। ফলাফল প্রকাশিত হলে ২ বিষয়ে ফেল করে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে। চোখে যেন নেমে আসে অমানিশার ছায়া। স্কুলজীবন শেষ করে গ্রামে থেকে এইচএসসিতে ভর্তি হয় ত্রিশাল নজরুল ডিগ্রি কলেজে।

বাবা শওকত আলী মাস্টারের তিন মেয়ে দুই ছেলের মধ্যে সবার ছোট সাদিকুর। বড় ভাই জন্ম থেকেই বাকপ্রতিবন্ধী হওয়ায় বাবার স্বপ্ন ছিল ছোট ছেলেকে নিয়েই, সেই ছেলে সাদিকুর বাবার স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয় এইচএসসিতে ফেল করে। ২০১১ সালে সাদিকুর প্রতিজ্ঞা করে- যে করেই হোক আমাকে এবার পাস করতেই হবে। ২০১১ সালে জিপিএ-২.৯০ নিয়ে পাস করলেও হতাশা পিছু ছাড়েনি। এই রেজাল্ট নিয়ে কোথায় ভর্তি হবে।

আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিলেও প্রথম তালিকায় ছিল না তার নাম, ২য় তালিকায় বাংলা বিভাগে তার চান্স হয়। সেইদিন খুশিতে কান্না করেছিলেন তিনি। অনার্স ৩য় বর্ষে নিজের হাত খরচ চালানো ও বাবার ওপর চাপ কমানোর জন্য প্রথমে একটি দোকানের সেলসম্যান পরে গার্মেন্টকর্মী হিসেবে চাকরি শুরু করেন। কয়েক মাস যাবার পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন সাদিকুর। ৩য় বর্ষের অনার্স পরীক্ষা দিলেও অসুস্থতার কারণে ৩য় বর্ষের ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি তিনি।

পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর থেকে ভাইভা দিতে হয়। এরমধ্যে বিয়েও করেন তিনি। ২০১৫ সালে অনার্সে সিজিপিএ পায় ২.৯৪। ২০১৬ সালে তার ঘরে আসে ফুটফুটে ছেলেসন্তান। ২০১৭ সালে পারিবারিক সমস্যার কারণে তার বাবা তাকে নিজে উপার্জন করে সংসার চালানোর আদেশ দিয়ে সব ধরনের খরচ বন্ধ করে দেন।

স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সাদিকুর পড়ে যান বিপাকে। চাকরি নেন চকরামপুর বাজার আমজাদ আলী মডেল স্কুলে ৩ হাজার টাকা বেতনের। তা দিয়ে বাসা ভাড়া, বাচ্চা ও নিজেদের সব খরচ চালাতে হতো। এটা দিয়ে কিছু না হওয়ায় জীবন যুদ্ধ শুরু হয় সাদিকুরের। সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত টিউশনি। ১১-৪টা পর্যন্ত স্কুল। সাড়ে ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত হোম টিউশনি। ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নিজের পড়াশোনায় সময় বের করা। তাকে সাপোর্ট দিয়েছেন তার সহধর্মিণী।

২০১৯ সালে প্রথম দেখেন আলোর মুখ। চাকরি হয় প্রাইমারি স্কুলে। সর্বশেষ ৪৩তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন তিনি। এখন বাবা-মাসহ এলাকার গর্ব সাদিকুর রহমান।

৪৩তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষা ক্যাডার সাদিকুর রহমান বলেন, আমার বড় বোন শারফুন্নাহার বিউটি আপা, স্কুলশিক্ষক হযরত আলী স্যার, আমার স্ত্রী আফসানা মিমি সাপোর্ট করার কারণেই এ অর্জন। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। এখন আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন। আমার বাবা, মা, স্ত্রী দুটি সন্তান নিয়ে দেশের শিক্ষা খাতে অবদান রাখতে চাই।

সাদিকুরের বাবা শওকত আলী বলেন, আমার দুটি ছেলে। বড় ছেলে বাকপ্রতিবন্ধী, ছোট ছেলে সাদিকুর। তাকে নিয়েই আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। মনে করেছিলাম সে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। বাবার সঙ্গে অভিমান করে সে যে সাফল্য অর্জন করেছে আমি অনেক গর্ববোধ করি। এলাকার মানুষও আমার ছেলের এ সাফল্যে অনেক আনন্দিত।

সাদিকুরের স্ত্রী আফসানা মিমি বলেন, আমার স্বামী অনেক পরিশ্রম করেছেন। রাত-দিন পরিশ্রম করে সংসার চালানোসহ পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছেন। বাব-মায়ের দোয়ায় সে সাফল্য অর্জন করেছে। এ অর্জন শুধু আমাদের নয় সবার। আমি চাই সামনের দিনগুলো সে দেশের হয়ে কাজ করুক।

অর্থসূচক/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.