পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ধরনের হতাশার খবর দিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট কোম্পানি লিমিটেড (বেক্সিমকো)। দুই বছর আগেও মার্কেট মুভার হিসাবে পরিচিত এই কোম্পানি চলতি হিসাববছরের (২০২৩-২৪) প্রথম প্রান্তিকে লোকসান দিয়েছে।
মাত্রই এক বছর আগে ইসলামী শরীয়াসম্মত বন্ড বা সুকুক ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল বেক্সিমকো। আর তার আগের বছরে কোম্পানিটির আয় বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। সেই সাথে বাড়ছিল শেয়ারের দামও। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল, সুকুকের টাকা ব্যবহারের পর কোম্পানিটির মুনাফা ও লভ্যাংশের পরিমাণ আরও বাড়বে। কিন্তু তাদের ওই আশায় বালি পড়েছে। সুকুক ইস্যুর পরের বছরেই আয় কমে গিয়েছিল কোম্পানিটির। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশও দিয়েছে কম। নতুন অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের হতাশা আরও বেড়েছে। কারণ কোম্পানিটি মুনাফা থেকে লোকসানের কবলে পড়েছে।
উল্লেখ, দীর্ঘদিন মন্দায় থাকার পর ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে চাঙ্গা হতে থাকে দেশের পুঁজিবাজার। এ সময়ে লেনদেন পরিমাণ ও সূচক বৃদ্ধিতে বেক্সিমকো লিমিটেডকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। ওই বছরের ২০ জুলাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল মাত্র ১৩ টাকা। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে এটি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণে (২৫.৬০ টাকা) উন্নীত হয়। আগস্ট মাস থেকে বেক্সিমকোর শেয়ারের দর বৃদ্ধির গতি আরও বেড়ে যায়।
শেয়ারের দর বৃদ্ধির ধারার মধ্যেই ২০২১ সালের মার্চ মাসে জানা যায় কোম্পানিটি সুকুক ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। তার কিছুদিন আগেই কোম্পানিটি বেক্সিমকো হোল্ডিংস থেকে ৩৫ কোটি টাকায় বেক্সপাওয়ার নামে একটি কোম্পানির সাড়ে তিন কোটি শেয়ার কেনে। তিস্তা সোলার লিমিটেড ও করতোয়া সোলার লিমিটেডের ৮০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে বেক্সপাওয়ারের কাছে। সুকুকের মাধ্যমে সংগ্রহ করা অর্থের বড় অংশ এই তিস্তা সোলার ও করতোয়া সোলারে বিনিয়োগ করা হবে বলে জানানো হয়।
সুকুক ইস্যুর খবরে বেক্সিমকোর শেয়ার আরও তেজী হয়ে উঠে। ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে ১৮৭ টাকায় উঠে। তবে সুকুক ইস্যুর পর থেকেই কোম্পানিটির শেয়ারের গতি উল্টোদিকে মোড় নেয়। শেয়ারের দর হারাতে থাকে কোম্পানিটি। বর্তমানে এটি ফ্লোরপ্রাইস ১১৫ টাকা ৬০ পয়সায় আটকে আছে। লেনদেন হয় না বললেই চলে। রোববার (৫ নভেম্বর) ডিএসইতে বেক্সিমকোর মাত্র ৫২টি শেয়ার কেনাবেচা হয়।
রোববার (৫ নভেম্বর) প্রকাশিত বেক্সিমকোর অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি হিসাবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই’২৩-সেপ্টেম্বর’২৩) ৭০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানিটি ৩৩৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছিল।
গত বছর প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় ছিল ৩ টাকা ৮৩ পয়সা। বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ৭৯ পয়সা লোকসান দিয়েছে।
প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেক্সিমকো ৫শ ৮১ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। গত বছরের একই সময়ে পণ্য বিক্রির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির বিক্রির পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা বা ৬৯.৭০ শতাংশ।
বিপুল মুনাফা থেকে এমন লোকসানের কারণ সম্পর্কে জানতে বেক্সিমকোর গ্রুপ কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ আসাদউল্লাহ এফসিএস এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি অর্থসূচককে বলেন, এ বিষয়ে (পণ্য বিক্রি কমে যাওয়া ও লোকসানের কারণ) কথা বলার জন্য তিনি অনুমোদিত ব্যক্তি নন।
এদিকে প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের নোটে কোম্পানিটি এই লোকসানের কিছু কারণ উল্লেখ করেছে। কোম্পানির দাবি অনুসারে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধীরগতির কারণে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা অস্বাভাবিকরকম কমে গেছে। অন্যদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও ডলারের সরবরাহ ব্যবস্থায় সঙ্কটের কারণে কাঁচামালের মূল্য অনেক বেড়েছে। ডলারের সঙ্কটের কারণে বেড়েছে ব্যয়। এর উপর গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিও কোম্পানির মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
গত মাসে বেক্সিমকো লিমিটেড ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে। একইসাথে প্রকাশ করে ওই বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন।
সর্বশেষ বছরের জন্য কোম্পানিটি ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। আগের বছর কোম্পানিটি ৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল।
অন্যদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের কোম্পানিটি ৭০৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা নিট মুনাফা করে। আগের অর্থবছরে মুনাফার পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৫৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আগের বছরের তুলনায় কোম্পানিটির মুনাফা কমেছে ৫৪৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বা ৪৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমে।
অন্যদিকে সর্বশেষ হিসাববছরে বেক্সিমকোর শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয় ৭ টাকা ৯২ পয়সা, যা আগের বছর ১৪ টাকা ০১ পয়সা ছিল।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.