মন্ত্রিসভা অনুমোদিত সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ প্রত্যাখ্যান করেছে টিআইবি

‘‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ এর খসড়ায় নির্বতনমূলক ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’’- এর বিতর্কিত ধারাসমূহের সন্নিবেশ ঘটেছে, যদিও শাস্তি ও অআমলযোগ্য ধারার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। খসড়াটি আইনে পরিণত হলে, ডিজিটাল মাধ্যমে মত ও তথ্য প্রকাশ করলে ব্যক্তি আইনি হেনস্তার শিকার হবেন বলে মন্তব্য করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এমন বাস্তবতায় সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চর্চা, উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তুর আলোকে এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের মতামতকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানাচ্ছে সংস্থাটি।

আজ টিআইবির ধানমণ্ডি কার্যালয়ে ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইন : একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা’’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলম ও ডেটা প্রোটেকশন অফিসার ড. মো. তরিকুল ইসলাম তুলনামূলক পর্যালোচনাটি করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে উপস্থাপনাটি তুলে ধরেন শেখ মন্জুর-ই-আলম।

প্রস্তাবিত আইনের ধারা ৮, ৯, ১০, ও ১১- অনুযায়ী সাইবার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ডেটা বা ইনফর্মেশন দুটোই অপসারণ করার জন্য বিটিআরসিকে বলবেন এবং ৮(২) তে বলা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনে করলে কোনো তথ্য উপাত্ত দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ কিংবা জনশৃঙ্খলা বিষয় ক্ষুণ্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ বা ঘৃণা সঞ্চার করে, তা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পদক্ষেপ নিতে পারবে। এইসব বিষয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা এই আইনে নেই, তাই এখানে ব্যাখ্যা এবং অপব্যাখ্যা করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করতে হবে, যা খুবই বিপদজনক।

ক্ষতিকর কন্টেন্ট অপসারণ করার প্রয়োজন আছে, তবে তা সীমিত পরিধির মধ্যে থাকতে হবে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ইন্টারন্যাশনাল কভেনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিকাল রাইটস এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। সর্বোপরি প্রস্তাবিত আইনের বিভিন্ন ধারার মাধ্যমে মত প্রকাশ, কথা বলা, কিংবা তথ্য উপাত্ত উপস্থাপনের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে কারাদণ্ড বাদ দিয়ে অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে, যা সাংবিধানিক অধিকারকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই আইনে অপরাধ তদন্ত এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশকে ঢালাও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সাইবার অপরাধসংক্রান্ত কারিগরি জ্ঞান বা বিশেষায়িত সক্ষমতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আছে কি-না সেটি পর্যালোচনা করা দরকার। একই সঙ্গে বিচারিক নজরদারির কথা বলা হয়নি। আমল অযোগ্য কিংবা জামিনযোগ্য ধারা হলেও আমাদের চিন্তার অনেক বিষয় আছে, কারণ পুলিশের অ্যারেস্ট করার অনুমতি থেকেই যাচ্ছে। জামিন নিতে হবে উচ্চ আদালত থেকে। এক্ষেত্রে ধারার বিধান পরিবর্তন করলেও আমরা কিন্তু একই জায়গায় আছি, কারণ পুলিশ মনে করবে এবং অ্যারেস্ট করবে।

অধিকন্তু বিচারিক নজরদারি করার ক্ষেত্রে যে সক্ষমতা দরকার, তা আছে কি-না, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা ও পর্যাপ্ত  জ্ঞান না থাকলে তারা কিসের ওপর ভিত্তি করে ওয়ারেন্ট ইস্যু করবেন? সেটিও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।

সর্বপরি শুধুমাত্র ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব না করে সাইবার স্পেসে যে সকল অপরাধ ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে, তা মনিটরিং করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সাইবার অপরাধ শুধু দেশের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না, বরং এটির আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল আছে। বাংলাদেশে অন্যান্য দেশ থেকে অনেক ধরনের সাইবার হামলা হয়েছে, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হ্যাক করে টাকাও চুরি করা হয়েছে। প্রকৃত সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এইসব বিষয়ে আমাদের নজর দেওয়া উচিৎ।

আমাদের সাইবার নিরাপত্তা নীতিমালা অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে সাইবার স্পেসে নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছিল, তবে এখন পর্যন্ত দেশে যে সাইবার ক্রাইম হয়েছে, তা থেকে বুঝা যায় আমাদের কারিগরি দক্ষতা বাড়েনি এবং আমরা সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছি।

উপস্থাপনায় বলা হয় ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর থেকে রাজনৈতিক কর্মীদের মাধ্যমে কিংবা ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণেই হোক আইনটির যথেচ্ছ অপব্যবহার হওয়ায় এটি হয়রানির হাতিয়ারে পরিণত হয়। দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে একটা পর্যায় গিয়ে দেখা গেলো যে, এটি সংশোধন অযোগ্য। তখন থেকেই টিআইবি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়- আইনের অপব্যবহার ও সাইবার নিরাপত্তা। এই দুটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই টিআইবি সাইবার নিরাপত্তা-সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়নের কথা বলেছে। প্রস্তাবিত আইনটির নাম সাইবার নিরাপত্তা দেওয়ায় কিছুটা আশার সঞ্চার করলেও, খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেলো মূলত শিরোনামের পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু উদ্বেগের জায়গাগুলোতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি, যা খুবই হতাশার। খসড়া আইনের সাইবার নিরাপত্তা আইনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের বিধান বাড়ানো বা কমানো হয়েছে। কিছু কিছু অপরাধকে জামিনযোগ্য ও অআমলযোগ্য বলা হয়েছে।

খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইন জাতীয় সংসদে পাশ হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইনে পরিণত হওয়ার এবং এর ফলে সংবিধানপ্রদত্ত মানুষের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হওয়ার ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি হবে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মৌলিক দুর্বলতা খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রয়ে গেছে ও উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। খসড়া আইনে মানুষের মৌলিক অধিকার অর্থাৎ মত প্রকাশের অধিকার, বাক্স¦াধীনতা, বিবেক, চিন্তা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করার মত উপাদানগুলো বাস্তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনুরূপ রয়ে গেছে। সুতরাং পূর্বসূরীর মতো এটিও যে একটি নির্বনমূলক আইনে পরিণত হতে চলেছে- এমন ধারণা হওয়া মোটেই অমূলক নয়। পাশাপাশি, ডিজিটাল মাধ্যমে মত ও তথ্য প্রকাশ করলে ব্যক্তি ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারেন- এমন ধারণাও সাধারণের মধ্যে অধিকতর জোরালো হবে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, সংবিধানে স্পষ্টভাবে ঘোষিত মত প্রকাশ, বাক্স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকারসমূহ অপরাধ হিসেবে গণ্য করার মত পর্যায়ে আমরা চলে যাচ্ছি। তাই আইনটি যে পর্যায়ে আছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।’

‘আইনের মূল উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু যদি হয় সাইবার নিরাপত্তা, সেখানে মানুষের মত প্রকাশ, বাক্ ও চিন্তার স্বাধীনতা খর্ব করে এমন উপাদান থাকার সুযোগ নেই। যদি ডিজিটাল মাধ্যমে মত বা তথ্য প্রকাশের কারণে কারো মানহানি হয় বা যদি প্রতারণা, জালিয়াতি ও অর্থ পাচার ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত হয়, তার জন্য প্রচলিত আইনে বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনে এর বিচার করার পেছনে কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি আছে বলে আমরা মনে করি না। সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমসহ সকল অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে আর্ন্তজাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে খসড়া আইনটি ঢেলে সাজাতে হবে।’

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.