বিকাশ-নগদে চলছে অবৈধ লেনদেন

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশেও বিনিয়োগের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে বিটকয়েন। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ব্যাপক উত্থান-পতনের মধ্যে চলে লেনদেন। এরমধ্যেও সার্বিক ঊর্ধ্বগতি বজায় রেখেছে ডিজিটালের প্রধান মুদ্রাটি। গত বছর বিটকয়েনে ব্যাপক পতন হয়। এর ফলে দর নেমে আসে ১৫ হাজার ৮৮৩ ডলারে। যা এর আগে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৬৮ হাজার ডলারে উঠেছিলো। সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ এসব মাধ্যমে লেনদেন নিষিদ্ধ করে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া বাংলাদেশে সরকারিভাবে জুয়া নিষিদ্ধ হলেও শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ যুব সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়া। এসবের অধিকাংশ লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, নগদ, উপায় ও রকেটের মতো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে।

তথ্য অনুযায়ী, বেশ কিছুদিন আগেই ক্রিপ্টোকারেন্সি ও বিটকয়েনে লেনদেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এমএফএস প্রতিষ্ঠানসহ বৈদেশিক মুদ্রা সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিঠি দেয় আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেন এ ধরনের লেনদেন করা না যায়, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছিলো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ নির্দেশনা মানছেনা অনেক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বিভিন্ন এমএফএস প্রতিষ্ঠানের হিসাবে বিটকয়েনে ব্যবহৃত ডলারের ক্রয়-বিক্রয় বাড়ছে হু হু করে। এর ফলে বিক্যাশ, নগদ ও রকেটে লেনদেন চলছে ২৪ ঘণ্টা। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবেও চলছে ডলার কেনা- বেচার পেমেন্ট দেওয়ার কার্যক্রম।

এবিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক অর্থসূচককে বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমে এসব লেনদেন হচ্ছে না। তবে অন্য মাধ্যমে প্রায়ই লেনদেনগুলো সম্পন্ন হচ্ছে। যারা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করছে তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ধরবে। আমরা ক্রিপ্টো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছি। আমরা যেহেতু এখানে বিনিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেছি তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিৎ এদের ধরা। কেনো অবৈধ লেনদেন করা হচ্ছে তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

এদিকে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৪৭ অনুযায়ী ভার্চুয়াল কোনো মুদ্রার স্বীকৃতি নেই বলেও জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি জানায়, যেকোনো ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন বা আইনগত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল মুদ্রা ব্যবহারের অনুমোদন নেই। এছাড়া ভার্চুয়াল মুদ্রা বা ভার্চুয়াল সম্পদের বিপরীতে কোনো আর্থিক দাবির সুযোগ নেই। কোনো আইন এ ধরনের সম্পদের গ্যারান্টি দেয় না।

জানা যায়, বিটকয়েন কেনা-বেচার জন্য প্রয়োজন হয় ডলার। এসব ডলার সংগ্রহে বাংলাদেশে বেশকিছু পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে ‘পিটুপি’ পদ্ধতি। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্রাহকেরা খুব সহযে ও দ্রুত সময়ের মধ্যে বিকাশ,নগদ, রকেট ও ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের পেমেন্ট করতে পারে। এক্ষেত্রে অনেক সময় মাত্র ৫ মিনিটেও লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন গ্রাহকেরা। এরপর সেই ডলার ব্যবহার করে কেনা হয় বিটকয়েন সহ অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রাগুলো। বিনিয়োগ করার পরে বড় লোকসানে পড়লে দেশ থেকে ডলার চলে যায় বিদেশে। এভাবে প্রতিবছর দেশ থেকে ব্যাপকহারে ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে।

এসব বিষয়ে বিকাশের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, বিটকয়েনে সঙ্গে যুক্ত লেনদেন একেবারেই অবৈধ। কেউ যদি এমএফএস, ব্যাংক হিসাব বা অন্য কোনো মাধ্যমে এই কাজগুলো করে থাকে তাহলে তা অবশ্যই অবৈধ। এসব ব্যাক্তিরা নিজেদের সক্ষমতার মধ্যে থেকেই এগুলো করছেন। তবে এগুলো আমাদের নজরে আসলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই। এই ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি সজাগ রয়েছি। খবর পেলে মুহূর্তের মধ্যেই আমরা একাউন্টগুলো বন্ধ করি। আমাদের প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রিত। তাই গাইডলাইন অনুযায়ী আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করি। সবসময় এসব লেনদেনকে অনুৎসাহিত করি। কোনো হিসাবের লেনদেন সন্দেহজনক হলে আমরা সাথে সাথে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) জানাই। আমাদের নিজেদের তদারকি ব্যবস্থার মাধ্যমে এগুলো চিহ্নিত করি। যেখানেই আমরা এরকম অবৈধ লেনদেনের খোঁজ পাবো, সেখানেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

সদ্য বিদায়ী ২০২২ সালের জানুয়ারি শেষে বিটকয়েনের দর ছিলো ৩৭ হাজার ৭৮০ ডলারে। এর পরের মাসে দাম আরও বেড়ে দাড়ায় ৪৪ হাজার ৩৪৭ ডলার। আলোচিত বছরটির মার্চ মাস শেষে কয়েনটির দাম আরও বেড়ে দাড়িয়েছিলো ৪৭ হাজার ৪৫৬ ডলারে। এরপরে বিটকয়েনের দামের এই উত্থান আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ধারাবাহিক পতনে গত জুনে দর নেমে আসে ১৯ হাজার ১০ ডলারে।

এরপরেও ধারাবাহিকভাবে দর কমতে থাকে প্রধান ডিজিটাল মুদ্রাটির। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ব্যাপক পতনে দাম কমে দাড়ায় ১৫ হাজার ৮৮৩ ডলার। এরপরে চলতি মাসের শুরু থেকেই সামান্য উত্থান শুরু হয়। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সময়ে সামান্য উত্থানে ২৩ হাজার ডলারে বিটকয়েনের লেনদেন চলছে। এদিকে বিশ্ব ডিজিটাল মু্দ্রার বাজার মূলধন দাড়িয়েছে ১ দশমিক ০৪ ট্রিলিয়ন ডলারে।

আলোচ্য সময়ে বাজারের প্রধান মুদ্রা বিটকয়েনে দাম কমার প্রভাব পড়েছে অন্যান্য কয়েনে। ২০২২ সালের শুরুতে ইথেরিয়ামের দাম বেড়ে দাড়িয়েছিলো ৩০ হাজার ৬৭০ ডলার। জুনের শুরুতে ব্যাপকহারে মুদ্রাটির দাম কমে দাড়িয়েছিলো ১ হাজার ৫৯৩ ডলারে। সদ্য বিদায়ী বছরের শেষ মাস অর্থাৎ ডিসেম্বরের শুরুতে কয়েনটির দাম আরও কমে দাড়ায় ১ হাজার ২০০ ডলারে। তবে চলতি মাসে কয়েনটিতে সামান্য উত্থান হয়েছে। এসময়ে ইথেরিয়ামের সামান্য পতনে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ উত্থানে ১ হাজার ৫৭১ ডলারে লেনদেন চলছে।

এদিকে গত বছরের শুরুতে বিএনবি কয়েনের দাম বেড়ে ঠেকেছিলো ৫০০ ডলারে। সেবছর জুনে কয়েনটির পতনের মুখে দাম ২২০ ডলারে নেমে আসে। নভেম্বরে দাম কিছুটা বেড়ে দাড়িয়েছিলো ৩২২ ডলারে। এভাবে উত্থান-পতনে চলছে লেনদেন। এদিন বিএনবি কিছুটা পতনে ৩০৬ ডলারে লেনদেন হচ্ছে।

এভাবে ব্যাপক উত্থান-পতনে ডিজিটাল এসব মুদ্রার লেনদেন সম্পন্ন হয়। এরপরেও দেশের অনেক মানুষ এসব লেনদেনে জড়িয়ে পড়ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে খুব সহযেই লেনদেন সম্পন্ন করা হয়। এছাড়া দেশের কয়েকটি ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমেও বিটকয়েনে ব্যবহৃত ডলার কেনা-বেচার পেমেন্ট দেওয়া হয়। ব্যাপক পতনের মুখে পড়ে অর্থ হারিয়ে নিস্ব হয়ে পড়ছেন এসব বিনিয়োগকারীরা। সচেতনতার অভাব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বারবার সতর্কতার ফল পাওয়া যাচ্ছেনা বলেই এমনটা ঘটছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

লেনদেনের বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর অর্থসূচককে বলেন, বিটকয়েন আমাদের দেশে বৈধ না। কোনো ব্যাংক এসব লেনদেন বৈধভাবে নিতে পারে বলে আমার মনে হয় না। তবে বিকাশ ও নগদে যদি ব্যক্তি টু ব্যক্তি লেনদেন করে সেটি অন্য বিষয়।

তথ্য অনুযায়ী, বিটকয়েন সহ অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রাগুলোর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। একইসঙ্গে থাকেনা লেনদেনের কোনো গ্যারান্টি। এছাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই, মুদ্রা খোয়া গেলে বা দরপতন ঘটলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে বিটকয়েন কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরও থেমে নেই এর লেনদেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর ব্যবসা বেআইনিভাবে বাংলাদেশেও প্রসারিত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সরকারের ই-গভর্মেন্ট কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিমের (সার্ট) প্রকল্প পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহ অর্থসূচককে বলেন, সরকারি আইন হিসেবে বিটকয়েন কেনা-বেচা সম্পূর্ণ অবৈধ। এরকম কোনো তথ্য দিলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ব্যাবস্থা গ্রহণ করবে। অনেক সাইট বিটকয়েন কেনা-বেচার কথা বলে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। এরকম অনেকের টাকা নিয়েই তারা পালিয়েছে। এসব বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাভুক্ত। যারা এসব লেনদেনের সঙ্গে জড়িত তার সবাই ঠকে যাচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন জুয়ার সাইট ওয়ানএক্সবেট। এছাড়া বেটউইনার, বেট৩৬৫, মেলবেট এবং প্যারিম্যাচ সাইটও বেশ জনপ্রিয়। এগুলোর বিজ্ঞাপন নিয়মিত দেওয়া হয় ফেসবুক ও ইউটিউবে। দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এ সাইটগুলোতে ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলা নিয়ে বাজি ধরা যায়। ক্রিকেটে প্রতি বলে বলে, ম্যাচের প্রথম ওভারের প্রথম বলে, প্রতি ওভারে, প্রতি ম্যাচের প্রথম ছয় ওভার, পরবর্তী ওভারে উইকেট যাবে কি না ও কোন দল জিতবে এমন করে জুয়ার ক্যাটাগরি সাজানো। দেশের ঢাকা শহর সহ বিভিন্ন এলাকায় এসব অনলাইন জুয়া ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

অর্থসূচক/সুলাইমান/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.