ইসলামী ব্যাংকের ঋণের বিষয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশ

ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

রোববার (৪ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন।

একই সঙ্গে ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপসহ পৃথক চারটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘটনায় অর্থপাচার হয়েছে কি না, সে বিষয়ে দুদক ও বিএফআইইউ সংশ্লিষ্টদের অনুসন্ধান করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। অনুসন্ধান শেষে চার মাসের মধ্যে এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়া জন্য বলা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লোপাটের ঘটনায় কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে।

আদালতে দুদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান ও রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক উপস্থিত ছিলেন।

পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, ব্যাংকের ঋণ নিয়ে পত্রিকায় যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এ বিষয়ে কোর্ট আদেশ দিয়েছেন, আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সংবাদের সত্যতা যাচাই করার দুর্নীতি দমন কমিশন, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউকে তদন্ত করে আগামী ৫ এপ্রিল প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত। ঋণ নেওয়ার বিষয়ে এস আলম গ্রুপকেও জানাতে বলা হয়েছে। আদালত বলেছেন, আমরা কোনো পক্ষ না। আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটা যাচাইয়ের জন্য আদেশ দিচ্ছি। আমরা যেভাবে শপথ নিয়েছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি কোনো বিষয় থাকে সেটা আমরা দেখব।

গত ২৪ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের প্রথমাংশে বলা হয়, ব্যাংকের নথিপত্রে নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডের অফিসের ঠিকানা বনানীর বি ব্লকের ২৩ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ভবন। ঋণ পাওয়া মার্টস বিজনেস লিমিটেডের ঠিকানা বনানীর ডি ব্লকের ১৭ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে মিলল রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের অফিস। তবে মার্টস বিজনেস লাইন নামে তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এভাবেই ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে দুই কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র।

সবমিলিয়ে বিভিন্ন উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি বছরেই এ অর্থ নেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ তুলে নেওয়া হয় চলতি মাসের ১ থেকে ১৭ নভেম্বর সময়ে। যার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা।

এর মধ্যে গত ২৯ নভেম্বর নিউ এইজ পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই প্রতিবেদনটিও আদালত নজরে নিয়েছেন।

একইভাবে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে কোম্পানিগুলো। ফলে এ তিন ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদসহ দেনা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এমন সময়ে এসব অর্থ তুলে নেওয়া হয়, যখন ব্যাংক খাতে ডলার-সংকটের পর টাকার সংকট বড় আলোচনার বিষয়।

এদিকে ইসলামী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে রাখা হচ্ছে না পর্যাপ্ত জামানত। এমন তথ্য ফাঁস হতে থাকায় আতঙ্ক বাড়ছে ব্যাংকটির আমানতকারীদের মধ্যে। এদের কেউ কেউ ব্যাংকটি থেকে তাদের আমানত তুলে নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ কমছে। শুধু গত নভেম্বর মাসে ব্যাংকটিতে আমানত কমেছে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকে মনিটরিং বাড়ানোয় বেপরোয়া ঋণে কিছুটা লাগাম পড়বে বলে আশা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। আর এখনো ব্যাংকটিতে দেড় লাখ কোটি টাকা আমানত থাকায় আতঙ্কের কিছু নেই বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, আর যাতে কোনো বেনামী ঋণ বিতরণ না হয় সেটি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিতরণকৃত ঋণের অর্থ উদ্ধারে মনোযোগ দিলে ব্যাংকটি তার আগের শক্তিশালী অবস্থান ফিরে পাবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ অর্থসূচককে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যে ইসলামী ব্যাংকের উপর একটি পরিদর্শন চলছে। এসব বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত জানানো হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জামানত ছাড়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়ায় এখন ঝুঁকিতে পড়েছে ব্যাংকটির আমানত। আতঙ্কিত হয়ে আমানতকারীরা টাকা তুলে নিতে শুরু করেছেন।

চলতি অর্থবছরের ৩০ নভেম্বর এসে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ দাড়িয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। গত ৩১ অক্টোবর শেষেও ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিলো ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যাবধানে ব্যাংকটির আমানত কমেছে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.