ছুটে চলা ঘোড়াটিকে একটু বিশ্রাম দিয়ে আবার সূর্যাস্তের দিকে যেতে চাই: বিদায়ী গভর্নর

৪২ বছর ধরে ছুটে চলা দূরন্ত ঘোড়াটিকে একটু বিশ্রাম দিয়ে আবার সেই ছুটন্ত ঘোড়ায় চড়েই সূর্যাস্তের দিকে যেতে চান সদ্য বিদায়ী গভর্নর ড. ফজলে কবির।

রোববার (০৩ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে শেষ কর্মদিবসে সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এভাবেই অনুভূতি ব্যক্ত করেন ফজলে কবির। অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথি ছিলেন গভর্নরের সহধর্মিণী ও সাবেক সচিব মাহমুদা শারমীন বেনু।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গর্ভনররা।

বিদায়ী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘৪২ বছর যে ঘোড়ায় চড়ে আসছি সেই ঘোড়াটাকে একটু রেস্ট দেব। আমি রেস্ট নেব। তারপর আবার সেই ঘোড়ায় চড়ে আমি সূর্যাস্তের দিকে চলে যাব৷’

বিদায়ী গভর্নর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে ৬ বছর ৩ মাস দায়িত্ব পালন করেছি। আমার এখন বিশ্রাম দরকার। বিশ্রামে তো এখনো আছি। কিন্তু টেনশনমুক্ত বিশ্রাম দরকার।’ এখন থেকে আর কারো ফোন কলে আমার স্ট্রেস হবে না। আপনাদের কাছ থেকেও স্ট্রেসলেস ফোন কল পাবো। ‘

বিদায় বেলায় আবেগাপ্লুত হয়ে গভর্নর বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার ছয় বছর তিন মাস পার হয়ে গেল। অথচ মনে হচ্ছে এই তো সেদিন দায়িত্ব নিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার পর যখন দেশে ফিরছিলাম, বিমানবন্দরে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন, আপনার প্রথম কাজ কী হবে? আমি বলেছিলাম, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা। এরপর কর্মকর্তাদের মনোবল চাঙা করা।’

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পারফরম্যান্স অসাধারণ। অন্য কোথাও এমনটি পাওয়া যায় না। এখানে অনেক মেধাবীর সমন্বয় ঘটেছে। দেশের অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে এমনটি দেখা যায় না। যা আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে পেয়েছি।

তিনি বলেন, এখানে সবার কাজ খুব উন্নতমানের। তাদের মধ্যে অনেক অতিমেধাবী আছেন। এটা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ে আমি পাইনি। সবাই কাজ নিবেদিতভাবে করেন। সবাই কাজ খুব উপভোগ করেই করেন। সবার ভালোবাসা আমি পেয়েছি৷

আমি দেশের অর্থনীতির জন্য যা করতে পেরেছি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি। তা হলো সম্মান ও ভালোবাসা। আমি সরকারের কাছ থেকেও অনেক সম্মান পেয়েছি। এর মধ্যে মুজিববর্ষ, পদ্মা সেতুর স্মারক নোটে আমার স্বাক্ষর রয়েছে। এটা অনেক সম্মানের।’

বিদায়ী গভর্নর বলেন, করোনার সময় অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। সবার ধারণা ছিল টিকা কার্যক্রম শেষ হলে চ্যালেঞ্জ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জ তার কোনো সীমা নেই। আমি এক মেয়াদের চ্যালেঞ্জ রেখে বিদায় নিচ্ছি। আমার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে যিনি গভর্নর হবেন, তিনি মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলার রেটের মতো চ্যালেঞ্জ শক্ত হাতে মোকাবিলা করবেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তখনকার গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। এর পরের দিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ সাবেক অর্থ-সচিব ফজলে কবিরকে চার বছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১তম গভর্নর হিসেবে যোগ দেন ফজলে কবির। সেই হিসাবে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ১৯ মার্চ। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩৪ দিন আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গভর্নর হিসেবে তার মেয়াদ তিন মাস ১৩ দিন বাড়িয়ে দেয় সরকার। যা ওই বছরের ৩ জুলাই শেষ হওয়ার কথা ছিল।

ওই সময় এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৬৫ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ফজলে কবির গভর্নর থাকবেন। পরে গভর্নর পদের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন সংশোধন করা হয়। ফলে ফজলে কবিরের মেয়াদ ২০২২ সালের ৩ জুলাই পর্যন্ত বেড়ে যায়।

সেই হিসাবে, প্রথম দফায় চার বছর, দ্বিতীয় দফায় তিন মাস ১৩ দিন এবং তৃতীয় দফায় এক বছর ১১ মাস ১৫ দিন অর্থাৎ মোট ছয় বছর তিন মাস গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান ফজলে কবির।

ফজলে কবির ১৯৫৫ সালের ৪ জুলাই মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে রেলওয়ের সহকারী ট্রাফিক সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী থাকার সময় তিনি ছিলেন সচিব। পরে তাকে অর্থ-সচিব করা হয়।

অর্থসূচক/এমএস/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.