কেবল পরিবহন নয়, অর্থনৈতিক করিডর হবে পদ্মা সেতু

স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্ততে রূপ নিয়েছে। এই সেতু কেবল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় যাতায়াত সুবিধাই দেবে না, জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখবে। গতি আসবে ব্যবসা-বাণিজ্যে। গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। বিকশিত হবে পর্যটন শিল্প। সেখানে কর্মসংস্থান হবে, মানুষের আয় বাড়বে, কমবে দারিদ্র্য। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু কেবল পরিবহন করিডর নয়, অর্থনৈতিক করিডরে রূপান্তরিত হবে এই সেতু।

পদ্মার বুকে নির্মিত দেশের দীর্ঘতম এ সেতু চালু হওয়ায় এসব অঞ্চলে কৃষি বিপ্লব হবে। কেননা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই কৃষিতে উন্নত। সেসব কৃষিপণ্য এখন খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। এতে দেশের অর্থনীতি সচল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবে। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে। কৃষকরা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে ঢাকাসহ সারাদেশে তাদেও উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজে বাজারজাত করে অধিক লাভ করতে পারবেন।

এই প্রসঙ্গে বুধবার (২২ জুন) অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পদ্মা সেতু হওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষি বিপ্লব হবে। সেখানে কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে উঠবে। তিনি বলেছেন, ওপারে যেন কৃষিনির্ভর শিল্প হয়, সেদিকেই আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। তিনি বলেন, খাদ্য উৎপাদন হলে দেশের খাদ্য চাহিদাও মেটানো যাবে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করলে শুধু রপ্তানি নয়, দেশেও বাজার সৃষ্টি হচ্ছে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যে সড়ক ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে তাতে পণ্য পরিবহণে সময় কমে যাবে, ব্যয়ও কমে আসবে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্যের একটি বড় বাজার শুধু রাজধানীতেই নয়, অন্যান্য অঞ্চলগুলোতেও বিস্তৃতি লাভ করবে। দক্ষিণাঞ্চলে যখন গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সংযোগ বাড়ানো হবে, তখন শুধু কৃষিভিত্তিক শিল্পই সেখানে গড়ে উঠবে না, ম্যানুফ্যাকচারিং বা অন্যান্য ধরনের ভারী শিল্পও বিস্তৃতি লাভ করবে। কেননা সেখান থেকে বন্দরের সুবিধা পাওয়া যাবে, যা বহিঃবাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় সুবিধা করবে। আন্তঃবাণিজ্য যেটা বিভিন্ন অঞ্চলের উৎপাদিত কাঁচামাল সেগুলোও পদ্মা সেতু ব্যবহার করে দক্ষিণাঞ্চলে সহজে যেতে পারবে।

জানা গেছে, পদ্মা সেতু দিয়ে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর, মোংলা ও পায়রাবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা আরো সহজ হবে। শিল্পদ্যোক্তাদের কাছে গুরুত্ব বাড়াবে এ বন্দরগুলোর। এতে রপ্তানি বাণিজ্য আরো সহজ ও সাশ্রয়ী হবে। সেতু ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইকনোমিক জোন), পর্যটন, ইকোপার্কের পরিকল্পনা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে হিমায়িত মৎস্য ও পাটশিল্পের নতুন সম্ভাবনা। পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসার অপেক্ষায়। এর ফলে দেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আরো সহজ হবে।

বর্তমানে দেশে আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) ও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু আছে। এর মধ্যে পদ্মার ওপারে শুধু মোংলা ইপিজেড। পদ্মা সেতুকে ঘিরে যশোর ও পটুয়াখালীতে আরও দুটি ইপিজেড করার প্রস্তাব আছে। এতে এ অঞ্চলে রপ্তানিমুখী খাতে নিয়োগ হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্রে জানা গেছে, মোংলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও পায়রা বন্দর এলাকায় চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা রয়েছে। গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের ভাঙ্গায় দুটি বিসিক শিল্পনগরী হচ্ছে। মাদারীপুরে তাঁতপল্লি নির্মাণের কাজও চলছে।

মহাসড়কের আশপাশে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী কলকারখানা করতে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, মাগুরা, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় জমি কিনে রেখেছে।

পর্যটন খাতও অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। সুন্দরবন, কুয়াকাটাসহ অন্যান্য পর্যটন এলাকায় মানুষের আনাগোনা বাড়বে। এসব এলাকায় পাঁচ তারকা মানের হোটেল নির্মাণেরও পরিকল্পনা করছে।

সব মিলিয়ে প্রতিবছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে শতকরা ১ দশমিক ২৩ শতাংশ, আর রেল যোগাযোগ পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে এর পরিমাণ আরো ১ শতাংশ হারে বাড়বে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ।

পদ্মা সেতুর বহুমুখী কার্যক্রম নিয়ে সেতু বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেতুকে কেন্দ্র করে দুই পাড়ে ২৯ শতাংশ বাড়বে নির্মাণকাজ, সাড়ে ৯ শতাংশ কৃষিকাজের প্রবৃদ্ধি, ৮ শতাংশ বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খাতের কাজ। এর প্রভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ কোটি লোকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে। ফলে পদ্মা নদীর ওপারে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার কমবে ১ শতাংশ। ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য কমলে এর প্রভাব পড়বে সারাদেশে। তখন জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার কমবে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জিডিপি প্রবৃদ্ধির একই কথা বলা হয়। এই সেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। জিডিপিতে অবদান বাড়লে স্বাভাবিকভাবে তা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদ্মা সেতুর কারণে জিডিপি বাড়লে দারিদ্র্য বিমোচনের হার বাড়বে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ।

পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু শুধু পরিবহন করিডর নয়, এটাকে অর্থনৈতিক করিডর ভাবতে হবে। পদ্মা সেতু ঘিরে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বিনোদনকেন্দ্র, পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠবে। সমান্তরাল এসব প্রকল্পেও সমান মনোযোগ দিতে হবে। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। এ জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করবে, তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কেননা এগুলো জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। তিনি বলেন, শুধু টোল সংগ্রহ নয়, পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বহুমাত্রিক এবং বহুমুখী অবদান রয়েছে। এর সুবিধা পেতে এখন আমাদের যথাযথ কৌশল নিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.