১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ২ হাজার ৭৫৬ কোটি ডলার

করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই আমদানিতে জোয়ার বইছে। রফতানি আয় বাড়লেও সেই তুলনায় বাড়ছে না। এতে রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি (আমদানি ও রফতানির মধ্যে ব্যবধান) তৈরি হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৬ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮০১ কোটি ডলার। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২ হাজার ২৮০ কোটি ডলার।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এত বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েনি দেশ। বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ও লেনদেন ভারসাম্যে বড় অঙ্কের ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমদানির লাগাম টেনে ধরা। যে করেই হোক এটা করতে হবে। তা না হলে সংকটে পড়বে পুরো অর্থনীতি।

এই প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘লাগামহীন আমদানিতে বেশ চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। ব্যালান্স অফ পেমেন্ট ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার।

তিনি বলেন, এখন যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। এছাড়া আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই।’

ডলারের দাম নির্ধারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডলারের দামের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো ধরে রাখার চেষ্টা করছে। যা কোনভাবেই ঠিক নয়। এটা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমি শুরুথেকেই বলছি এটা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বাজারই নির্ধারণ করবে ডলারের দাম কতো হবে।

তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণভাবে অর্থনীতিতে আমদানি বাড়াকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়ে থাকে। কেননা আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। এতদিন আমরাও সেটা বলে আসছি। কিন্তু এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ৫০ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির নেই। এখন এটা কমাতেই হবে। তা না হলে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়বে দেশের অর্থনীতি।’

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহষ্পতিবার (০২ জুন) বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়,  চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ৪১ দশমকি ৪২ শতাংশ। আলোচিত ১০ মাসে রপ্তানি থেকে দেশ আয় করেছে ৪ হাজার ১১০ কোটি ডলার। পণ্য আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৮৬৭ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় থেকে রপ্তানি আয় বাদ দিলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় দুই হাজার ৭৫৬ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার হিসেবে (প্রতি ডলার ৯০ টাকা) যার পরিমাণ ২ লাখ ৪৮ হাজার ১২১ কোটি টাকা।

তথ্য বিশ্লেণে দেখা যায়, জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৭৩০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। গত অর্থবছরে একই সময় এসেছিল ২ হাজার ১১২ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

আলোচ্য সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৭৯৫ কোটি ডলার। অন্যদিকে সেবা খাতে দেশের ব্যয় হয়েছে ১১১৪ কোটি ডলার। সেবা খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩১৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ২১৫ কোটি ডলার।

চলতি হিসাব ভারসাম্যেও (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এই ঘাটতির (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৬৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

সামগ্রিক লেনেদেনে (ওভার অল ব্যাল্যান্স) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ৭৫০ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।

দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলে ২৮৭ কোটি ১০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৩৮৮ কোটি ২০ লাখ ডলারে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়। আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও আগের বছরের চেয়ে ৫৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়ে ১৮৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১২১ কোটি ডলার।

অর্থসূচক/এমএস/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.