‘ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে’

দেশের পুঁজিবাজার হঠাৎ করেই চরম অস্থির হয়ে উঠেছে। আজ সোমবার (১৬ মে) নিয়ে টানা ৪দিন বাজারে দর পতন হয়েছে। এই সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ২৬৮ পয়েন্ট বা প্রায় ৪ শতাংশ। আজ একদিনেই সূচক কমেছে ২ শতাংশের বেশি। ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ৯১ শতাংশ শেয়ারের মূল্য কমেছে। লেনদেনের এক পর্যায়ে অনেক শেয়ার ক্রেতা-শূন্য হয়ে পড়ে।

অর্থসূচকের পক্ষ থেকে বাজারের এই পরিস্থিতির কারণ ও বিনিয়োগকারীদের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল ডিএসই ব্রোকার অ্যাসোসিয়েনের (ডিবিএ) সভাপতি ও গ্লোবাল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিওকে।

বাজারে তীব্র দর পতনের তেমন কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন ডিবিএ সভাপতি। তিনি বলেন, বেশ কিছু কারণে দেশের অর্থনীতি এই মুহূর্তে কিছুটা চাপে আছে। কিন্তু এই চাপ সামলে উঠার মতো ক্ষমতাও আছে আমাদের। এর আগের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা এবং করোনাভাইরাস অতিমারি আমাকে অর্থনীতিকে কাবু করতে পারেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক বিনিয়োগকারীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা যে কোনো দামে শেয়ার বিক্রি করে দিতে চাচ্ছেন। তাতেই সূচকের বড় পতন হচ্ছে। মূলত মনস্তাত্ত্বিক কারণেই এমন অস্থির হয়ে উঠেছে বাজার।

তিনি মনে করেন, বাজার নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। আমাদের অর্থনীতি বিদ্যমান চাপ কাটিয়ে উঠতে পারবে। সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রয়োজনে আরও ব্যবস্থা নেবে হয়তো। অকারণে ভীত হয়ে লোকসানে শেয়ার বিক্রি না করে বিনিয়োগকারীদের উচিত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা। দুই বছর আগেও কিন্তু করোনা পরিস্থিতির প্রভাবে বাজার অনেকটা গতিহীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এরপর এই বাজারকেও দারুণ গতিশীল হতে দেখেছি আমরা। লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে এক সময়। শেয়ারের দাম এবং সূচকও অনেক বেড়েছে। এখন যে অবস্থা চলছে সেটিও নিশ্চিতভাবেই সাময়িক। বাজার আবার গতিশীল হবে। যারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবেন, তারা তখন লাভবান হবেন। আর লোকসান দিয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিলে কিন্তু ওই লোকসান বুক করা হয়ে যায়। তাতে কমে যায় মূলধন। ফলে আর ওই ঘাটতি পূরণ করা সহজ হয় না।

রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, বাজারের বর্তমান পরিস্থিতির কারণ মোটেও বাজার সংশ্লিষ্ট নয়। সামগ্রিক অর্থনীতির চাপসহ অন্যান্য ঘটনার প্রভাবে বাজারে দরপতন হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে তীব্র মূল্যস্ফীতি শুরু হয়েছে। তাতে আমাদের দেশেও মূল্যস্ফীতি অনেকটা বেড়েছে। একই কারণে বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। ডলারের দাম বেড়েছে। এগুলোর কিছু প্রভাব আছে পুঁজিবাজারে। অন্যদিকে শ্রীলংকায় সম্প্রতি যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তারও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আছে। বাংলাদেশে শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির কোনো আশংকা না থাকলেও অনেক বিনিয়োগকারী অহেতুক ভয় পাচ্ছেন। অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি এড়াতে কিছু সমস্যা তুলে ধরে করণীয় সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন। সরকারও সতর্কতামূলক কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে। এসব পরামর্শ ও ব্যবস্থার ভুল অর্থ করা হচ্ছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ নিজেরা যেমন ভুল অর্থ করছেন, তেমনই কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠিও এসব বিষয়কে সামনে রেখে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এই আতঙ্ক থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠায় পরিস্থিতি নাজুক হয়ে যায়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার মূলত ব্যক্তি বিনিয়োগকারী নির্ভর। এই বাজারের ৮০ শতাংশ লেনদেন করে থাকেন তারা। বিশ্ব জুড়েই ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা সহজে প্রভাবিত হন। তারা গুজবে বিশ্বাস করেন, হুজুগে সিদ্ধান্ত নেন। বিভিন্ন সময়ে অসাধু চক্র ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠি তাদের ফায়দা হাসিলের জন্য তাদেরকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে থাকেন। বাংলাদেশের বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ কম থাকায় এটি সহজ হয়।

ডিবিএ সভাপতি বলেন, এমনিতে বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ কম। এর মধ্যে প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে আইসিবি বিভিন্ন সময়ে বাজারে মন্দা পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে গতি ফেরানোর চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু এবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের জন্য আইসিবি বাজারকে সাপোর্ট দিতে পারেনি। বরং দুর্বল বাজারেও শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগের কিছু অংশ তুলে নিতে হয়েছে। তাতেই পতনের তীব্রতা বেড়ে গেছে। কিন্তু এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আইসিবিকে আর শেয়ার বিক্রি করতে হবে না। বরং তারা নতুন করে বিনিয়োগ বাড়াবে।

পুঁজিবাজারের অন্যতম সফল একজন বিনিয়োগকারী রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, সব সময় পরিস্থিতি একরকম থাকে না। পরিস্থিতি অনুকূল না থাকলে বিনিয়োগকারীদের উচিত ধৈর্য্য ধরে অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষা করা। কোনো বাজারে যেমন অনন্ত সময়ের জন্য শেয়ারের দাম বাড়তে পারে না, তেমনই তা কমতেও পারে না। দাম যৌক্তিক পর্যায়ের নিচে নেমে গেলে এক সময় তা বাড়তে বাধ্য, যদি কোম্পানির ব্যবসা ও মৌলভিত্তি ঠিক থাকে। তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা। বরং কারো কাছে বিনিয়োগ উপযোগী অর্থ থাকলে, এটি হচ্ছে বিনিয়োগের জন্য একটি উপযোগী সময়।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.