পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রীর ভবনে শনিবার রাতে যা ঘটেছিল

বহু নাটকীয়তার পর সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন। ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে যখন পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নানা ঘটনা ঘটছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী ভবনেও ঘটেছে অনেক নাটকীয় ঘটনা। সবার নজর পার্লামেন্টের দিকে থাকলেও প্রধানমন্ত্রী ভবনে তখন অনেকগুলো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, একের পর এক ঘটনা ঘটেছে। তার কিছু ক্যামেরার সামনে ঘটেছে, কিছু ঘটেছে রুদ্ধদ্বার কক্ষে। খবর- বিবিসি

যখন ইফতারের কারণে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের অধিবেশন মুলতুবী করা হয়, তখন হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী ভবন সরগরম হয়ে ওঠে। দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন ইমরান খান। সেখানে তার আইন এবং রাজনৈতিক উপদেষ্টাও অংশ নেন। সেই সঙ্গে পার্লামেন্টের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং কয়েকজন আমলাকেও ডেকে পাঠানো হয়।

মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ইমরান খানের অভিযোগ অনুযায়ী, পাকিস্তান সরকারকে উৎখাত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের যড়যন্ত্রের বিষয়টি কিছু কর্মকর্তার কাছে প্রকাশ করা হবে। সেই সময় পাকিস্তান পার্লামেন্টের স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার প্রধানমন্ত্রী ভবনে এসে পৌঁছান, তবে তাদের লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে বলা হয়।

এ সময় হেলিকপ্টারে করে দুইজন অনাহুত অতিথি এসে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রীর ভবনে। ভবন ঘিরে অস্বাভাবিক নিরাপত্তা প্রস্তুতি আর সশস্ত্র ব্যক্তি সজ্জিত হয়ে আসা ওই ব্যক্তি ইমরান খানের সঙ্গে পৌনে এক ঘণ্টা ধরে বৈঠক করেন। এই দুইজন অতিথির উপস্থিতি ইমরান খানের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। তিনি অবশ্য হেলিকপ্টারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু যারা আসবেন বলে তিনি প্রত্যাশা বা ধারনা করেছিলেন, ঘটেছিল একেবারেই তার উল্টো।

বিবিসি উর্দু সার্ভিসকে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইমরান খান আশা করছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশে পার্লামেন্ট বসার পর সেখানে যে হইচই শুরু হয়েছে, এরপর তিনি সেনাবাহিনীতে সদ্য যেসব রদবদল করেছেন, সেই সামরিক কর্মকর্তারা হেলিকপ্টারে করে তার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। সেটা হয়তো হতো, কিন্তু সমস্যা হলো, সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে যে বৈপ্লবিক রদবদল তিনি করতে চেয়েছিলেন, সেটা কার্যকর করতে হলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয়। কর্মকর্তাদের বরখাস্ত বা নতুন কর্মকর্তা নিয়োগের সেই আইনি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়নি। ফলে ইমরান খানের বরখাস্ত আদেশ বা নতুন নিয়োগের আদেশ কার্যকরও হয়নি।

পরের দিন সকালে আইএসপিআর একটি বিবৃতিতে বলেছে, বিবিসি যে প্রতিবেদন করেছে, তার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার মিল নেই। এই প্রচারিত সংবাদের সঙ্গে কোন নির্ভরযোগ্য, প্রামাণিক বা প্রাসঙ্গিক সূত্র উল্লেখ নেই। এটা সাংবাদিকতার মৌলিক মূল্যবোধেরও বিরোধী। এই বানানো খবরে কোনরকম সত্যতা নেই এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে বিভ্রান্তিমূলক খবর ছড়ানো হচ্ছে, এটা তারই অংশ।

তবে সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, সদ্য পদ হারানো প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শনিবার রাতে যাতে এরকম কোন রদবদল করতে না পারেন, সেজন্য রাতেই আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। যদি ইমরান খানের রদবদলের আদেশের প্রক্রিয়া সম্পন্নও করা হতো, তারপরেও সেটা যাতে বাতিল হয়ে যায়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল।

শনিবার মধ্যরাতে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট খোলা হয় এবং সেখানকার প্রধান বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডেকে পাঠানো হয়। তখন জানানো হয়েছিল যে, হাইকোর্ট একটি জরুরি পিটিশনের শুনানি করবে, যেখানে অভিযোগ করা হয়েছে যে, ইমরান খান রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন এবং সেনাপ্রধানকে পদচ্যুত করার সুপারিশ করেছেন। ফলে জনস্বার্থে আদালতের ওই আদেশ বাতিল করে দেয়া উচিত। তবে শেষপর্যন্ত যেহেতু ইমরান খানের ওই আদেশ কার্যকর হয়নি, ফলে ওই পিটিশনেরও আর শুনানি হয়নি।

তবে এর কিছু পরে, মধ্যরাতে পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করেন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার। এরপর পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অনাস্থা ভোটে গদি হারান ইমরান খান। ভোটাভুটি শুরুর কিছুক্ষণ আগেই অবশ্য তিনি প্রধানমন্ত্রী ভবন ছেড়ে চলে যান।

পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১৮ সালের জুলাইয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে। তখনও দেশটির সেনাবাহিনীর ভূমিকা তার বিজয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছে- এমন কথাই প্রচলিত ছিলো।

পাকিস্তানকে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ে নেতৃত্ব দেয়া খান ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই আর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে। কিন্তু বাস্তবতা হলো অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই ধীরে ধীরে বিপাকে পড়তে শুরু করে তার সরকার। এক পর্যায়ে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগ নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়ান তিনি।

আবার রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা শুরু করে, তখন তার মস্কো সফরও পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ভালো ভাবে নেয়নি। এর মধ্যেই তার ক্ষমতাসীন জোটের বড় অংশ এমকিউএম তাকে ছেড়ে বিরোধী জোটে যোগ দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারায় তার সরকার।

এ-ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই ইমরান খান বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলেন, এরা ‘বিদেশি রাষ্ট্রের’ সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্র, কারণ তিনি রাশিয়া এবং এবং চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এজন্যেই তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।

তবে ডেপুটি স্পিকার কাসেম সুরি রুল জারি করেন যে, এই অনাস্থা প্রস্তাব পাকিস্তানের সংবিধানের পঞ্চম অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে, যেটিতে রাষ্ট্র এবং সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের কথা আছে। এরপর ইমরান খান পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। এর ফলে ৯০ দিনের মধ্যে পাকিস্তানের পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান বিরোধী নেতারা। তারা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংবিধানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। এরপরই তারা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করতে যান এই বলে যে, অনাস্থা ভোট আটকে দিয়ে সরকার তার সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করেছে।

এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ বিরোধী দলগুলো সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় এবং তাদের আবেদনে বলা হয় যেভাবে অনাস্থা প্রস্তাবটি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আটকে দেয়া হয় তা ছিল বেআইনি ও অসাংবিধানিক। শুনানির পর সুপ্রিম কোর্ট কাসেম সুরির রুল এবং পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। সেই সঙ্গে শনিবার রাতের মধ্যে অনাস্থা ভোট আয়োজনের জন্য আদেশ দেন।

শনিবার সারাদিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন তিন চার দফা মুলতুবি হবার পর পাকিস্তানে মধ্যরাতের পর অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পরিষদের ৩৪২জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন সদস্য তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হল।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.