মূল্যস্ফীতির সরকারি হিসাব বাস্তবতার সঠিক চিত্র নয়: সিপিডি

সরকারি খাতায় খাদ্য-মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায়ও কম। কিন্তু এটা বাস্তবতার তুলনায় সঠিক চিত্র নয় বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

সিপিডি কার্যালয়ে রবিবার (২০ মার্চ) ‘পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে?’ শীর্ষক আলোচনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি, বহিঃখাত, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং খাত এবং বাজেট ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলোকপাত করেন বক্তারা। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো মো. তৌফিক ইসলাম খান। এ সময়ে আরও বক্তব্য রাখেন সিপিডির ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমানসহ বিশিষ্টজনরা ।

সিপিডির গবেষণাপত্র উপস্থাপনের সময় ফাহমিদা খাতুন বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। কিন্তু সরকারি খাতায় খাদ্য-মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায়ও কম। কিন্তু এটা বাস্তবতার তুলনায় সঠিক চিত্র নয়। নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। খাদ্য বহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতিও বেশ বেড়েছে।

তিনি বলেন, খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ও খাদ্য বহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে— একটি বাড়লে আরেকটি কমে। খাদ্য-মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেশি। এক একটি পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে ১৫, ২০ ও ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। তারপরও খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি কীভাবে স্থিতিশীল? আমরা বাজারে সেটা লক্ষ্য করি না। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজের মূল্য যদি আলাদাভাবে দেখি, তাহলে দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়ে যায়। তারপরও দেখি মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে গড়ে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ । কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রকৃত মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্য ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ওই সময়ে আয় ৫৩ শতাংশ কমে ৪৬ শতাংশ হয়েছে। এখানে দেখা গেছে, আয় বাড়লেও প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে তিন ধরনের চালের (মিনিকেট, পাইজাম ও মোটাচাল) দাম বিবেচনায় নিয়ে দেখা গেছে—চালের বাজার ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের তুলনায় অনেক ঊর্ধ্বমুখী। একইভাবে ময়দা, চিনি, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, পাউডার মিল্ক, ডিম ও মাংসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি ফারাক। অসম্ভব বেড়েছে এসব পণ্যের দাম। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধির কারণই একমাত্র দায় নয়। বিপরীতে আমরা দেখতে পাই, সিগারেটের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক কম। স্বাস্থ্যহানিকর পণ্য হিসেবে কর বৃদ্ধি করে করের আওতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। যদিও এখন বেশি আছে, কিন্তু আরও বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। সেজন্য সিপিডি নিত্যপণ্যের সরবরাহ যাতে যথেষ্ট থাকে সেটার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়। পাশাপাশি কিছু পণ্যে বাজারে মনোপলির একটি প্রবণতার কথা তুলে ধরে।

তিনি আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ দেখি না। বিশেষ করে সংকটের সময় কয়েকটি আমদানিকারক ও বিক্রেতাকে বেশি সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থাও জরুরি। সরকার চেষ্টা করছে, যদিও তা যথেষ্ট নয়। এর পরিসর বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রক্রিয়াটি দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। সংকট পরিস্থিতিতে নগদ সহায়তা চালু রাখা যেতে পারে।

সিপিডি জানায়, রফতানি বাড়ছে, কিন্তু সেই তুলনায় আমদানি বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহও কমে গেছে। কয়েকটি পণ্য আমাদের ও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য। কৌশলের অংশ হিসেবে আগেভাগেই জ্বালানি তেলের মজুত বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মূল্যও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেটা আরও বেড়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষে তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ৯৫ দশমিক ৮ ডলার ও মার্চে ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। যেখানে এক বছর আগেও ব্যারেল প্রতি ৬৫ ডলার ছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যুদ্ধ যদি না থামে সামনে দাম আরও বাড়বে।

সংগঠনটির মতে, সরকারি ব্যয় সুচিন্তিতভাবে করা দরকার। যে ধরনের প্রকল্পে মানুষের কর্মসংস্থান হয়, সে ধরনের ব্যয় করতে হবে। আর যতগুলো প্রকল্প চলমান, সেগুলো দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে দেশে ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপি বেড়েই চলেছে। ব্যাংকগুলোকে ঋণ খেলাপির বিষয়ে এক ধরনের শৈথিল্য দেওয়া হয়। তারপরও এর উন্নতি হয়নি, বরং অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।

অর্থসূচক/আরএমএস/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.