‘নিত্যপণ্যের ওপর ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানো হতে পারে’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানো হতে পারে। খুব শিগগির এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

রোববার (১৩ মার্চ) সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। রমজান সামনে রেখে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এই আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। বৈঠকে সোমবার ভ্যাট-ট্যাক্স কমানো সংক্রান্ত এসআরও জারি করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, ক্যাবিনেট সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এবং পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদসহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

সভাশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ আলোচনা করেছি। আপনারা জানেন সারা বিশ্বেই ভোজ্য তেলের দাম বাড়ছে। এই দাম বৃদ্ধির কোনো মাত্রা নেই। আমরা প্রতিদিনই দেখছি দাম বাড়ছে। এর ইফেক্ট আমাদের দেশেও আসছে। অন্যান্য জিনিসের দামও রোজায় বাড়তে পারে, এটা মাথায় রেখেই আমরা বসেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘পাশাপাশি এই আলোচনায় ট্যাক্স ও ভ্যাটের কথা এসেছে। এটা কমানো যায় কি না সেটা নিয়েও আমরা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি খুব শিগগিরই। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ট্যাক্স ও ভ্যাট কমানো বা তুলে নেয়া হতে পারে। নিত্য পণ্যের ওপর ভোজ্যতেল বা চিনি বা আরও কিছু যদি চলে আসে সেগুলোর ওপরে কীভাবে কতটুকু কমানো যায় সেটি নিয়ে আমরা খুব শিগগিরই একটি ঘোষণা দেব। এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।’

এসময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘আমরা ২ ফেব্রুয়ারি তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। এটাই তার আগের মাসের অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের ইমপোর্ট প্রাইসের ওপরে করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ব্যবসায়ী সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে এটা সত্যি।

‘আমরা কিন্তু প্রাইস ফিক্সড করেছি কথাবার্তা বলেই। আলোচনা হয়েছে আমরা কোথাও স্টক হোল্ড করতে দেব না। কোনো সুযোগ নিতে দেবো না। এজন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে যেখানে যেখানে এ চেষ্টা করা হবে আমরা সেখানে ইন্টারফেয়ার করব। এমন না যে আজকে দাম বেড়েছে বলে তারা বাড়াচ্ছে, তারা চেষ্টা করছে আগের হিসাব ধরে বাড়ানোর।’

তিনি বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে কীভাবে এটা সাশ্রয়ী মূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে দেয়া যায়। সরকার যেটা করতে পারে সেটা হলো ভ্যাট-ট্যাক্সের ব্যাপারে। এ বিষয়ে একটি পজিটিভ সিদ্ধান্ত হয়েছে, আশা করছি কালকের মধ্যেই এটা নিয়ে উদ্যোগ নিতে পারব।’

টিপু মুনশি বলেন, ‘তবে আমি জানাতে চাই, এ সুযোগ নিয়ে কোনো অসাধুতা যেন প্রশ্রয় না পায়, এর জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। প্রত্যেক জায়গায় আমরা একটি টাস্কফোর্স গঠন করব, যাতে কেউ সুযোগ নিতে না পারে।’

এসময় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে জ্বালানি তেল ও গ্যাসসহ বেশ কিছু পণ্যের সরবরাহ বিঘিœত হতে পারে বলেও সতর্ক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়ার যে যুদ্ধ তাতে আমাদের তেল ও গ্যাসের সরবরাহ কিছু কিছু জায়গায় কমে যাচ্ছে। এটা সারা বিশ্বেই হচ্ছে। আমরাও এখানে এফেক্টেড হচ্ছি বা হব।

‘এরপর গমের সাপ্লাই, যেহতু এগুলো ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আসত আমরা একটু অসুবিধায় পড়তে পারি। দাম বৃদ্ধি হতে পারে। আমরা এটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এজন্যই এই সভায় বসেছি।’

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা এখন থেকেই ওএমএস কার্যক্রম বৃদ্ধি করব, যাতে স্বল্পমূল্যে জনগণের হাতে পণ্য পৌঁছে দিতে পারি। দ্রব্যের যে সাপ্লাই চেইন, সেটাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করব। আমরা প্রোডাক্ট স্টক নিয়ন্ত্রণ করব, কেউ যাতে মজুদ বেশি রেখে পন্যের মূল্য বাড়াতে না পারে।

‘ভোজ্য তেলের দামের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। একটা পরিসংখ্যান দিতে চাই, সয়াবিন তেল এক বছর আগে ছিল ১ হাজার ২৩৫ ডলার প্রতি টন, পামওয়েল ছিল ১ হাজার ৩২ ডলার প্রতি টন।’

তিনি বলেন, ‘এ বছরের ৯ মার্চ ভোজ্যতেল হয়েছে ১ হাজার ৯৩৫ ডলার প্রতি টন আর পামওয়েলে হয়েছে ১ হাজার ৮৯৭ ডলার প্রতি টন। ভোজ্য তেল ১০ শতাংশও আমাদের দেশে হয় না। আমরা পুরোটাই আমদানি নির্ভর। কাজেই পরিস্থিতি কী হতে পারে আপনারা উপলব্ধি করছেন। যে কোনো উপায়ে দাম যেন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি না হয় এটা আমরা নজর রাখব।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোজায় চাহিদা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে তড়িৎ আমদানির ব্যবস্থাও আমরা করছি। আমরা মোটামুটি সবাইকে উৎসাহ দেব যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যাতে তারা আমদানি করে মার্কেট স্থিতিশীল রাখে। আমাদের আরেকটি অসুবিধা হতে পারে, গমের সরবরাহ। যেহতু গম ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে আসে এখানেও সমস্যা হতে পারে। চাল-গমের বাজারটাও যাতে স্থিতিশীল থাকে এর জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।

‘রোজার সময় যাতে বিদ্যুত সরবরাহ কমে না যায়। আপনারা বুঝতে পারছেন যে ডিজেলের সরবরাহ কমে যেতে পারে। আমাদের গ্যাসের সরবরাহও কমে যেতে পারে। এগুলো ঠিক রাখার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি যাতে বিদ্যুতের ঘাটতি না হয়, জনগণ যেন অসুবিধায় না পড়ে।’

 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সারাদেশ ওএমএস কার্যক্রম বৃদ্ধি করব, ন্যায্য মূল্যে যাতে সাধারন মানুষের কাছে পণ্য পৌঁছাতে পারি। এর পাশাপাশি সাপ্লাইচেইনটা যাতে ঠিক থাকে সরকার সে ব্যবস্থা করবে। কোনো পণ্য যাতে কেউ স্টক করতে না পারে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা হবে।’

প্রসঙ্গত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫.৬ শতাংশ।
এর অর্থ হলো, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৫ টাকা ৬০ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। আগের মাস আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫.৫৪ শতাংশ। জুলাইয়ে হয়েছিল ৫.৩৬ শতাংশ।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫.৬৪ শতাংশ। এর পর থেকে প্রতি মাসেই বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। সেপ্টেম্বরে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় খাতেই অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫.৩ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই লক্ষ্য ধরা ছিল ৫.৪ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছর শেষ হয় ৫.৫৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে। অর্থাৎ বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে খানিকটা বেশি ছিল গড় মূল্যস্ফীতি।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করার পর থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছে। তার প্রভাব পড়েছে ছোট-বড় সব দেশে।

অর্থসূচক/এমএস/এএইচআর