আমদানি ব্যয়ে রেকর্ডের পর রেকর্ড

গতি ফিরছে দেশের অর্থনীতিতে। ফলে চলতি বছরের শুরুতে রফতানির পাশাপাশি আমদানিও বেড়েছে। রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে চলেছে বাংলাদেশ। সেই সাথে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও বেড়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে ৮৪৩ কোটি ৬৭ লাখ (৮.৪৪ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি (সিএন্ডএফ) করেছে বাংলাদেশ। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।

আমদানির এই রেকর্ডকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, যেহেতু আমদানি ব্যয়ের পাশাপাশি রফতানি আয়ও বাড়ছে। ফলে দেশের বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়ছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কেননা আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া। বিনিয়োগ বাড়া মানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হওয়া।

তবে, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে রফতানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স আরও বাড়ানোর দিকে জোর দিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এছাড়া, আমদানির আড়ালে যাতে এক পণ্যের জায়গায় অন্য পণ্য না আসে, বিদেশে টাকা পাচার না হয়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর মাসে ৮৪৩ কোটি ৬৭ লাখ (৮.৪৪ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি (সিএন্ডএফ) করেছে বাংলাদেশ, যা ২০২০ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে ৫৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। বর্তমান বিনিময়হার (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৭২ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য আমদানিতে এতো বেশি অর্থ ব্যয় হয়নি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করছেন। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে আমদানি ব্যয়। সেই সাথে বাড়ছে ডলারের চাহিদা। এতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে পড়েছে টান। বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম; কমছে টাকার মান।

এর আগে নভেম্বর মাসে ৭৮৫ কোটি ৪৬ লাখ (৭.৮৫ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল, যা ছিল এক মাসের হিসাবে এতদিন সর্বোচ্চ।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সবমিলিয়ে ৪ হাজার ২১২ কোটি ২৫ লাখ (৪২.১২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৪ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ছয় মাসে ২ হাজার ৭২৬ কোটি ৯২ লাখ (২৭.৬৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল, যা ছিল আগের বছরের (২০১৯-২০) জুলাই-ডিসেম্বর চেয়ে ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম।

প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, করোনা মহামারির কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় দ্বিতীয়ার্ধে এসে আমদানি বাড়তে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ৬৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড আমদানি খরচ নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয়।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকে বাংলাদেশেও করোনার প্রকোপ স্বাভাবিক হতে শুরু করে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোদমে চালু হয়। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে আমদানি। এখন প্রতি মাসেই রেকর্ড হচ্ছে।

জানা গেছে, গত দুই বছর করোনা মহামারির মধ্যেই দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। প্রথম দিকে আমদানি কমলেও পরে বেড়েছে। এখন করোনার প্রকোপ ফের বাড়লেও উৎপাদন কর্মকাণ্ডসহ সবকিছুই চলছে স্বাভাবিক গতিতে। তাই আমদানি বাড়ছে। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো।

এছাড়া, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। এ সব প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানিতে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে। এসব কারণেই গত অর্থবছরে আমদানি খাতে খরচ প্রথমবারের মতো ৬৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এবার আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) পণ্য রপ্তানি থেকে ২৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ; যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৩০ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এই সাত মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমেছে ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে মোট ১১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যঅন্স এসেছে দেশে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ১৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে, আমদানির জোয়ারে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভে টান পড়েছে। গত বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।

গত ৫ জানুয়ারি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গত এক মাসে তা বেড়ে এখন ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ওপর অবস্থান করছে।

অর্থসূচক/এমএস/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.