মহামারির আঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বছর

২০২০ সালের শুরুতেই মহামারি কোভিড-১৯ এর আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। ফলে অর্থনীতির প্রতিটি সেক্টরই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। সেই বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে সরকার বেশ কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব প্রণোদনা প্যাকেজের উপর ভর করেই অর্থনৈতিক সংকট অনেকাংশে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রণের বিস্তার নিয়ে আবারও আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতির এই পুনরুদ্ধার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নানা উত্থান-পতনের পর বছরের শেষে সামষ্টিক অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক ইতিবাচক হলেও কয়েকটি মৌলিক সূচক নেতিবাচক রয়ে গেছে। এসময় রিজার্ভ, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, আমদানি-রফতানি বেড়েছে। তবে এখনো মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ও রাজস্ব এসব খাতে চাপ রয়ে গেছে। এছাড়া করোনার প্রভাবে দেশে আয়-বৈষম্যও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এসব বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার প্রভাবে সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনীতির যে ক্ষতিটা হয়েছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের আরও সময় লাগবে এবং আরও অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন আমাদের আছে। সরকারকে সেই লক্ষ্যেই কাজ করার পরামর্শ দেন তারা।

সার্বিক বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর অর্থসূচককে বলেন, চলতি বছরের দুই-তৃতীয়াংশ সময়েই করোনার প্রভাব ছিল। তারপরেও দেশের সার্বিক অর্থনীতি সামাল দেওয়া গেছে। মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। অবশ্য বিশ্বজুড়েই এখন মূল্যস্ফীতি বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও চালের দাম চড়া। এর প্রভাব বাংলাদেশেও কিছুদিন থাকবে। অন্যদিকে আমদানি অনেক বাড়ছে। সেই তুলনায় রফতানি আয় এবং রেমিট্যান্স বাড়ছে না। ফলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে অসামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছে। এছাড়া, মুদ্রা বিনিময় হারে অসামঞ্জস্য আছে। ডলারের মূল্য ব্যাংকে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। আর খোলাবাজারে তা ৯০ টাকার বেশি। এক্ষেত্রে পার্থক্য অনেক বেশি। এতে ব্যাংক ব্যবস্থায় অর্থের স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, বাজেট ব্যবস্থাপনা নিয়েও অস্বস্তিতে আছে সরকার। অবশ্য রাজস্ব আদায় কম হলে সরকার খরচ কমিয়ে সামাল দিতে পারে। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও লক্ষ্য বেশি থাকায় এবারও কাক্সিক্ষত পরিমাণে রাজস্ব অর্জিত হবে না। ফলে সরকারকে উন্নয়ন খরচ কমাতেই হবে, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।

এই পরিস্থিতি উত্তরণে তিনি সরকারকে দুইটি পরামর্শ দিয়েছেন। এক. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে চাল আমদানি করতে হবে। চলতি বছরও ৮ লাখ টন চাল আমদানি করেছিল সরকার। আগামী বছর তা বাড়িয়ে ১৫-২০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হবে।

অর্থাৎ মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মান ৩ থেকে ৪ শতাংশ অবমূল্যায়ন করতে হবে। এতে ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, সামনে অমিক্রনের সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি আছে। অমিক্রন ভালোভাবে সামাল দিতে না পারলে অর্থনীতি আবার নাজুক অবস্থায় পড়ে যেতে পারে। সেই প্রস্তুতিও এখন থেকেই নিতে হবে।

রিজার্ভ: আমদানি ব্যয় বাড়ায় বাংলাদেশের রিজার্ভও কমছে, নেমে এসেছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে। তবে গত কয়েক দিনে তা আবার কিছুটা বেড়েছে। সর্বশেষ, ২৮ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল ৪৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৭ বিলিয়ন ডলার হিসেবে বর্তমানের এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

আন্তর্জাতিক মানদ অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়। গত ৪ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১১৩ কোটি ১০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা ছিল সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। বেশ কয়েক বছর ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। একের পর এক রেকর্ড হয়। করোনাকালের শুরুতে আমদানিতে ধীরগতি আর রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশের অর্থনীতির এই সূচক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে, যা ছিল অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

আমদানি: করোনার ধকল কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য আবার চাঙা হচ্ছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা নতুন কওে উৎপাদনে নামছেন। এতে প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।

রফতানি: করোনার বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় তৈরি পোশাক খাতের চাহিদা আবার বাড়তে শুরু করেছে। মূলত তৈরি পোশাক খাতের উপর ভর করেই দেশের রফতানি আয়ও বাড়ছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রফতানি আয় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। যদিও লক্ষমাত্রার তুলনায় তা অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত রফতানি আয় এক মাসে ৩৫০ কোটি ডলারের বেশি ওঠেনি। অক্টোবরে অবশ্য রফতানি আয় সর্বোচ্চ ৪৭২ কোটি ডলার হয়েছে। তবে নভেম্বরে তা কমে ৪০৫ কোটি ডলারে নেমেছে। আগস্ট থেকে রফতানি আয় বাড়তে থাকে। কারণ, ওই সময়ে শীত মৌসুমের তৈরি পোশাক ইউরোপ ও আমেরিকায় রফতানি শুরু হয়।

বিনিয়োগ: মহামারির কারণে গত বছর দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমেছিল ১১ শতাংশ। তবে চলতি বছর করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ফের বাড়ছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানিয়েছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ২০ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৬ শতাংশ বেশি।

বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহও বাড়ছে। যা দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি গত দুই বছর পর আবার দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। বিনিয়োগ বাড়ায় করোনার কারণে কাজ হারানো মানুষও আবার কাজ পেতে শুরু করেছেন।

রাজস্ব আয়: করোনার ধাক্কা কাটিয়ে রাজস্ব আদায়ে গতি ফিরছে। আমদানি রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে রাজস্ব আদায়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এই সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করেছে ১ লাখ ২৬৭ কোটি টাকা। তবে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে শুল্ক-কর আদায়ে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে এনবিআর। যদিও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি থাকায় অর্থনীতিতে কম রাজস্ব আদায়ের চাপ তেমন একটা নেই।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছিল। কিন্তু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) পুরোটা বাস্তবায়ন না হওয়ায় তাতে সরকারের অর্থের ঘাটতি হয়নি। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের এনবিআরের শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য হলো ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ৭৯ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যের মাত্র ২৪ শতাংশ।

বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন স্থায়ী খরচের বাইরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) খরচ করে। বেতন–ভাতার খরচ কমানো না গেলেও এডিপির খরচ কমানো সম্ভব। অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ১৩ শতাংশ টাকা খরচ হয়েছে। মোট এডিপির আকার ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এটি কাক্সিক্ষত হারে বাস্তবায়ন না হওয়ায় রাজস্ব আদায়ের চাপ তুলনামূলক কম।

রেমিট্যান্স: করোনার শুরুতে অর্থনীতির এই সূচকটিই সবচেয়ে বেশি সচল ছিল। ফলে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে রেমিট্যান্স। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও সচল হতে থাকে। ঠিক সেই সময় থেকেই কমতে থাকে অর্থনীতির অন্যতম এই সূচকটি।

অর্থাৎ ২০২০ সালকে প্রবাসী আয়ের উত্থান-পতনের বছর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, করোনার সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে তারা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর কমতে থাকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংকের সাথে খোলা বাজারে ডলারের পার্থক্য অনেক বেশি হওয়ার ফলেই এ অবস্থাটি সৃষ্টি হয়েছে।

টানা সাত মাস রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় কমেছে। গত মে মাসে ২১৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা সাম্প্রতিক কালে কোনো এক মাসে সর্বোচ্চ। এরপর প্রতি মাসেই রেমিট্যান্স কমেছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে ১৫৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। যদিও চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৯৬ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ১৭৮ কোটি এবং মার্চে ১৯১ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় আসে। এপ্রিলে ২০৬ কোটি ডলার ও মে মাসে ২১৭ কোটি ডলার পাঠান প্রবাসীরা। কিন্তু এরপর মে মাস থেকে আয় কমতে শুরু করে।

প্রবাসে শ্রমিক যাওয়াও কমেছে। সেইসঙ্গে বিশ্বজুড়ে আবার বাড়ছে ওমিক্রণের সংক্রমণ। ফলে সামনের দিনগুলোতে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরো কমার আশঙ্কা রয়েছে।

মূল্যস্ফীতি:  চলতি বছর জানুয়ারি মাসে ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে বছর শুরু হয়। পরের ছয় মাস কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। পরের পাঁচ মাস মূল্যস্ফীতি টানা বেড়েছে। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। করোনার ধকল কাটিয়ে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এর ফলে মানুষের হাতে টাকা যাচ্ছে। বাংলাদেশেও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় দেশেও ডিজেল-কেরোসিনের দাম বেড়েছে। ফলে পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে এর প্রভাব পড়েছে। অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.