২ নিয়ন্ত্রক সংস্থার মুখোমুখী অবস্থান, পুঁজিবাজারে অস্থিরতা আতঙ্ক

‌হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক গতিশীলতা। বিনিয়োগকারী ও স্টেকহোল্ডারদের স্বস্তি। হতাশা বাড়ছে তাদের মধ্যে। বাড়ছে উদ্বেগ। এর মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে গত মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত একটি বৈঠক। বিশেষ করে, ওই বৈঠকের প্রেক্ষিতে বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রেসরিলিজকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগকারীসহ পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঘটনায় আলোচিত ২ নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে বিদ্যমান তীব্র টানাপোড়েন ও মুখোমুখী অবস্থানের বিষয়টি উলঙ্গভাবে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাদের এই সাংঘর্ষিক অবস্থা পুঁজিবাজারে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এমন আশংকা বিনিয়োগকারী ও স্টেকহোল্ডারদের। তাতে তারা প্রচণ্ড হতাশ ও উদ্বিগ্ন। অর্থসূচকসহ সংশ্লিষ্টদেরকে তারা ফোনে এই উদ্বেগ-আতঙ্কের বিষয়টি জানিয়েছেন। হোয়টসঅ্যাপ-ম্যাসেঞ্জারেও তা শেয়ার করেছেন।

অনেক বিনিয়োগকারী আগ বাড়িয়ে আতঙ্ক ও কান্না মেশানো গলায় অনুরোধ জানিয়েছেন, ২ নিয়ন্ত্রক সংস্থার যৌথ কোনো বিবৃতি বা সংবাদ সম্মেলনের আগে পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ রাখার। তাদের আশংকা, এটি করা না হলে বাজারে বড় দরপতন হতে পারে। আর এই ধারা চলতে পারে বেশ কিছুদিন। যদিও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, মঙ্গলবারের ঘটনায় বাজারে সাময়িক দরপতন হলেও পুঁজিবাজার তার নিজস্ব শক্তিতেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

উল্লেখ, পুঁজিবাজার সংক্রান্ত নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের আহ্বানে মঙ্গলবার ২ নিয়ন্ত্রক সংস্থার আলোচিত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিএসইসি গঠিত পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর অবিতরণকৃত লভ্যাংশ স্থানান্তর, সুকুকসহ সব বন্ডের বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ (Capital Market Exposure) হিসাবায়ন থেকে বাইরে রাখা, শেয়ারের বাজারমূল্যের পরিবর্তে ক্রয় মূল্যে ওই হিসাবায়ন করাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক প্রস্তাব বিএসইসির পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়। এসব ইস্যু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। ইস্যুগুলোর কারণে পুঁজিবাজারের গতিশীলতা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ডেপুটি গভর্নর এ, কে, এম সাজেদুর রহমান খান। আর বিএসইসির পক্ষে নেতৃত্ব দেন কমিশনার প্রফেসর ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।

বৈঠকে শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিএসইসিতে এক ব্রিফিংয়ে ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, বৈঠকে আলোচনা ছিল ফলপ্রসূ। বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের বন্ডে বিনিয়োগকে এক্সপোজারের বাইরে রাখতে সম্মত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে। এছাড়া বাজারমূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যে ব্যাংকের এক্সপোজার হিসাব করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। তবে এটি টেকনিক্যাল বিষয় হওয়ায় এটি নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন হবে।

বৈঠকে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের খবরে বুধবার দারুণ চাঙ্গা হয়ে উঠে পুঁজিবাজার। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১৪৩ পয়েন্ট বেড়ে যায়। লেনদেনের পরিমাণও কিছুটা বাড়ে। এমন অবস্থায় বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানোর প্রেসরিলিজ বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটায়। এই প্রেসরিলিজে দাবি করা হয়, বৈঠকে এক্সপোজার সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশেষ করে নতুন আশায় বুক বেঁধে এদিন যেসব বিনিয়োগকারী বুধবার শেয়ার কিনেছিলেন, তাদের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়।

উল্লেখ, ২০১০ সালের ধসের প্রভাবে এক দশকেরও বেশী সময় জুড়ে পুঁজিবাজারে ছিল প্রচণ্ড স্থবিরতা। তবে বিএসইসির বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে ধীরে ধীরে এই চিত্র বদলে যেতে থাকে। বাজারে নতুন গতির সঞ্চার হয়। বাজারে লেনদেন এবং মূল্যসূচক বাড়তে থাকে। এতে বিনিয়োগকারী ও স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ধীরে ধীরে স্বস্তি ফিরে আসে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির বর্তমান কমিশন স্বপ্ন দেখাতে থাকেন, পুঁজিবাজারকে শিল্প-বাণিজ্যের দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে গড়ে তোলার। কিন্তু চলতি বছরের মাঝামাঝী সময়ে এসে হঠাৎ করে ওই স্বপ্ন যেন ফিকে হয়ে আসতে থাকে। আর এটি শুরু হয় আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে কিছু ইস্যুতে মতভিন্নতা ও টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে বিএসইসি গঠিত পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর অবিতরণকৃত লভ্যাংশ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি; সুকুকসহ সব বন্ডের বিনিয়োগকে এক্সপোজারের বাইরে রাখা এবং ক্রয়-মূল্য ও বাজারমূল্যে এক্সপোজার গণনা সংক্রান্ত জটিলতায় বাজার মাঝেমধ্যেই হোঁচট খায়। বিশেষ করে সম্প্রতি বেক্সিমকো লিমিটেডের সুকুকে বিনিয়োগের কারণে অনেক ব্যাংকের এক্সপোজার নির্ধারিত সীমার বাইরে চলে যায়। অনেক ব্যাংকের নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসে। তাতে বাজারে তারল্য সঙ্কট দেখা দিলে বাজার অস্থির হয়ে উঠে। আশা করা হয়েছিল মঙ্গলবারের বৈঠকে এসব যৌক্তিক ইস্যুর সমাধান হবে। সেটি তো হয়-ই নি, উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রেসরিলিজে বিনিয়োগকারীসহ স্টেকহোল্ডাররা বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্রেসরিলিজের ভাষা ও শব্দ চয়নের মধ্যে বিএসইসিকে অবজ্ঞা করা, সবার সামনে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিকে মিথ্যাবাদী প্রমাণের মাধ্যমে তার গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করার চেষ্টা ছিল বলেও মনে করেন অনেকে। একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক আরেকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এভাবে ছোট করার চেষ্টার ইঙ্গিতে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা আতঙ্কিত। তাদের আশংকা, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অযৌক্তিক ইগো বজায় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে, তাতে পুঁজিবাজারের সর্বনাশ হলেও তারা নির্বিকার থাকবে। আর এটিই সবাইকে আতঙকগ্রস্ত করে তুলেছে।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.