করোনায় প্রকট হচ্ছে আয় বৈষম্য

মহামারি করোনার অভিঘাতে বেশিরভাগ মানুষের আয় কমলেও কিছু মানুষের আয় বেড়েছে। ফলে এসময় আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে আয় বৈষম্য। এর ফলে একদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশে এখন কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। যা ছয় মাস আগেও ছিল প্রায় ৯৪ হাজার। অপরদিকে এক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী, করোনায় নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। বিনিয়োগকারীরাও নতুন বিনিয়োগ করছেন না। ফলে একদিকে যেমন মানুষের কর্মসংস্থান কমে গেছে অন্যদিকে ব্যাংকে বিনিয়োগকারীদের অলস অর্থ জমা হচ্ছে। এতে দেশের আয় বৈষম্য বাড়ছে।

এছাড়া, দুর্নীতির মাধ্যমে কালোটাকা অর্জন, হন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা, প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা ভিন্ন খাতে স্থানান্তর, করনীতিতে অসামঞ্জস্য, ধনীদের কাছ থেকে কম হারে কর আদায়ও দেশের আয় বৈষম্যের অন্যতম কারণ। এসব কারণে এক শ্রেণির মানুষের বৈধ ও অবৈধ উপায়ে আয় বাড়ছে। তবে আয় কমেছে এমন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ অবস্থায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর উপর সরকারকে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুন শেষে দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক কোটিপতি আমানতকারীর ব্যাংক হিসাব সংখ্যা ৯৯ হাজার ৯১৮টি। এসব ব্যাংক হিসাবে আমানতের পরিমাণ ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। ছয় মাস আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কোটি টাকার বেশি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। অর্থাৎ ছয় মাসে দেশে নতুন কোটিপতি আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৬ হাজার ২৮টি।

এদিকে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এই নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক সাম্প্রতিক জরিপে এসব তথ্য জানা গেছে।

জরিপে আরও বলা হয়েছে, মহামারি শুরু হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর প্রভাব অনেক বেশি।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, অতি ধনীদের হাতে এখন দেশের মোট আয়ের ৩৭ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা লকডাউনের আগে ছিল ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। এই কোভিড-১৯-এর লকডাউন আয় বৈষম্যও বাড়িয়েছে। যা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম অর্থসূচককে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে দেশের ব্যবসা- বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে। এসময় সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগে করছেন না। ফলে একদিকে যেমন বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের এসব অর্থ ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা হচ্ছে। এছাড়া, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেওয়া ঋণের একটা অংশও ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখা হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, মূলত দেশে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণেই আয় বৈষম্য বাড়ছে। এজন্য সরকারকে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর দিকে আরো বেশি মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। আর তা না হলে দেশে আয়-বৈষম্য আরো বাড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে দেশে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৬। এসব হিসাবে মোট আমানতের পরিমাণ ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটি টাকার হিসাব ৯৯ হাজার ৯১৮টি। এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট আমানতের প্রায় ৪৪ শতাংশই কোটিপতি হিসাব। ছয় মাস আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কোটি টাকার বেশি হিসাব ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। হিসাবগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৬ হাজার ২৮টি। আর এসব হিসাবে আমানত বেড়েছে ৩৯ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা।

অর্থসূচক/এমএস/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.