তিন কোম্পানির শেয়ার বিক্রিতে বিএসইসির নির্দেশনা প্রশ্নবিদ্ধ

লাগামহীনভাবে ছুটতে থাকা পুঁজিবাজারের রাশ টেনে ধরতে নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর অংশ হিসেবে সংস্থাটি তালিকাভুক্ত তিনটি কোম্পানি, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)কে শেয়ার বিক্রি করে বাজারে ফ্লোটিং শেয়ারের সংখ্যা পরিশোধিত মূলধনের ন্যুনতম ১০ শতাংশে উন্নীত করতে বলেছে।

রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) বিএসইসি কোম্পানি তিনটিকে এই নির্দেশ দিয়েছে।

আর এই নির্দেশনাকে ঘিরে দেখা দিয়েছে নানা বিতর্ক। বাজার সংশ্লিষ্টদের একটি বড় অংশ এই নির্দেশনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্তের ফলে কোম্পানির স্পন্সর ও পরিচালকরা লাভবান হবেন। কিন্তু কোম্পানি তিনটি এবং এদের বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভ হবে না। বরং বিনিয়োগকারীরা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়বেন। তাছাড়া সামগ্রিক বাজারে এই সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

তবে বিএসইসি বলছে, বাজারে শেয়ার সরবরাহ বাড়ানোর প্রক্রিয়া হিসেবে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাজারে আলোচিত কোম্পানি তিনটির শেয়ার সংখ্যা অনেক কম থাকায় দাম অনেক বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিদ্যমান পাবলিক ইস্যু রুলস অনুসারে, প্রতিটি কোম্পানিকে ণ্যুনতম ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়তে হয়। আগের আইনে এমন বাধ্যবাধকতা না থাকায় কোম্পানি তিনটি কম শেয়ার ছেড়েছিল। তাই নতুন শেয়ার ছাড়ার মাধ্যমে অন্য কোম্পানিগুলোর সাথে সামঞ্জস্য আসবে।

বিএসইসির নির্দেশনা অনুসারে, আলোচিত কোম্পানি তিনটিকে আগামী এক বছরের মধ্যে শেয়ার বিক্রির এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে। তবে কোনো মাসেই ১ শতাংশের বেশি শেয়ার বিক্রি করা যাবে না।

বিএসইসির নির্দেশনাটিকে ঘিরে উদ্বেগের প্রধান কারণ হচ্ছে, কোনো কোম্পানিই রিপিট আইপিও বা রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বাড়াবে না। কোম্পানির উদ্যোক্তা (Sponsor) ও পরিচালকরা তাদের হাতে থাকা শেয়ারের একাংশ বিক্রি করবেন। অনেকটা সরাসরি তালিকাভুক্তি (Direct Listing) পদ্ধতির মতো করে এই শেয়ার বিক্রি করা হবে। শেয়ার বিক্রির কোনো টাকা-ই কোম্পানিতে আসবে না। টাকা যাবে কোম্পানির সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের পকেটে।

প্রাথমিক হিসাব অনুসারে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন নির্দেশের ফলে কোম্পানি তিনটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ৮ কোটি ৪৫ লাখ ৫৯ হাজার ৪২২টি শেয়ার বিক্রি করতে হবে। বর্তমান বাজার মূল্যে যার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা।

বিএসইসির নির্দেশনাটিকে ঘিরে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। নির্দেশনা জারির খবরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আলোচিত তিন কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাদের আশংকা, বাড়তি শেয়ার ছাড়ার ঘোষণার ফলে কোম্পানি তিনটির শেয়ারের বড় মূল্য পতন হতে পারে। তাতে তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ কোম্পানি তিনটির স্পন্সররা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিলে বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বের হয়ে যাবে তাতে বাজারে তারল্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংকার, অ্যাসেট ম্যানেজার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আলোচিত নির্দেশনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রির শেয়ার বিক্রির বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

দেশের অন্যতম শীর্ষ একটি ব্রোকারহাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অর্থসূচককে বলেন, ওয়ালটনকে মাত্র ১ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছেড়ে তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ দিয়ে বিএসইসি বড় ভুল করেছে। কিন্তু তাদের ভুলের মাশুল বিনিয়োগকারীরা কেন দেবেন?

তিনি বলেন, আইপিওতে ১ শতাংশ শেয়ারের পরিবর্তে ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়া হলে বাজারে ওয়ালটনের শেয়ারের মূল্য বড়জোড় ৩শ টাকা হতে পারতো, কোনোভাবেই ১৪শ টাকা হতো না। কম শেয়ার ছাড়ার অনুমতি দিয়ে কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্যকে হাজার টাকার বেশি হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এখন এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা তাদের শেয়ার উচ্চমূল্যে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ টাকা বাজার থেকে নিয়ে যাবেন। এই টাকা ওয়ালটন হাইটেকের অ্যাকাউন্টসে আসবে না। ফলে কোম্পানির এবং এর বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভই হবে না।

তিনি আরও বলেন, বিপুল পরিমাণ টাকা বের হয়ে যাওয়ার কারণে বাজারে তারল্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। তবে এরচেয়ে বড় ভয়ের বিষয় হচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় টান পড়বে। কারণ কোম্পানির প্রসপেক্টাস অনুসারে, কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ারে ৩ বছরের লক-ইন থাকার কথা। এই তথ্য জেনে এবং বাজারে কোম্পানিটির ফ্লোটিং শেয়ারের পরিমাণ ১ শতাংশ ধরে নিয়ে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেছেন। এখন হঠাৎ করে সরবরাহ বেড়ে গেলে শেয়ারের দাম কমে গেলে তারা ব্যাপকভাবে লোকসানে পড়বেন। এর ফলে পুঁজিবাজারের কোনো আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো নির্দেশনার প্রতি আস্থা রাখতে পারবেন না বিনিয়োগকারীরা।

একজন শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংকার অর্থসূচককে বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে সামগ্রিকভাবে বাজারের উপর আস্থা তো নষ্ট হবে-ই, সবচেয়ে আস্থা হারাবে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির শেয়ার।

তিনি দু’টি উদাহরণ দিয়ে বলেন, কয়েক বছর আগে একতরফাভাবে তিতাস গ্যাসের হুইলিং চার্জ কমিয়ে দিয়েছিল বিইআরসি। এ ঘটনায় তিতাসের শেয়ারে থাকা বিদেশী বিনিয়োগকারীরা রাতারাতি তাদের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নেয়। কারণ, তাদের কাছে মনে হয়েছে, এখানে সরকারি নীতিতে কোনো ধারাবাহিকতা নাই। যখন তখন যে বাজারে বা যে দেশে নীতিমালা পরিবর্তন হয়, সেখানে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে চায় না।তিনি বলেন, নানা ঘটনায় সরকারি কোম্পানির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে। আইসিবির শেয়ার বিক্রির নির্দেশের ফলে এই আস্থা আরও কমবে। তাতে আগামী দিনে নতুন করে সরকারি কোম্পানির তালিকাভুক্তির সময় সরকার ওইসব কোম্পানির শেয়ারের প্রত্যাশিত দাম পাবে না।

তাদের মতে, এভাবে শেয়ার বিক্রি না করেও বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প সুযোগ আছে। কোম্পানি তিনটির স্পন্সরদের শেয়ার বিক্রির পরিবর্তে রাইট ইস্যুর মাধ্যমে শুধু সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদেরকে শেয়ার কেনার সুযোগ করে দিয়ে বাজারে কোম্পানি তিনটির ফ্লোটিং শেয়ারের সংখ্যা বাড়ানো যায়। তাতে করে, রাইটের টাকা কোম্পানি পাবে। ওই টাকা ব্যবহার করে কোম্পানি মুনাফা বাড়াতে পারবে। অন্যদিকে বাজারের টাকা ঘুরেফিরে বাজারেই থেকে যাবে।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.