প্রভিশন ঘাটতিতে ১১ ব্যাংক

করোনা মহামারির কারণে ঋণ পরিশোধে শিথিলতা থাকলেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ফলে ঝুঁকিবাহিত সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে বেগ পেতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। তবে পর্যাপ্ত আয় না থাকায় ১১টি ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি।

নিয়ম অনুযায়ী সরকারি, বেসরকারি, বিদেশিসহ সব ধরনের ব্যাংক যে ঋণ বিতরণ করে, তার গুণ-মান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য এ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, বেসিক, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এ তালিকায় রয়েছে। এছাড়া রয়েছে বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। জুন মাস শেষে এই ১১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিতে পড়েছে। এ ঘাটতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৮৭৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

তবে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমাণ পাঁচ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেওয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা জুন (২০২১) প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ০৭ শতাংশ।

গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকার বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেওয়ায় আদায় হচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন ছাড়ের কারণে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে খেলাপি বাড়ায় প্রভিশন রাখা যায় না। যারা প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ আদায় কম। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বেশি রাখতে হচ্ছে। এ কারণে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের আট দশমিক শূন্য ১৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে খেলাপি বেড়েছে ১০ হাজার ৪৭১ কোটি টাকার বেশি।

আলোচিত সময়ে যে ১১ ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে, তার মধ্যে সরকারি চার ব্যাংকের ঘাটতি ১১ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি জনতা ব্যাংকের। জুন শেষে জনতা ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৩৫১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। বেসিক ব্যাংকের তিন হাজার ৬৭১ কোটি ৭১ লাখ টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের এক হাজার ৫২৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ৯৪৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।

বেসরকারি খাতের ছয় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি তিন হাজার ৩৬২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংকের। জুন মাস শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দুই হাজার ৩৯৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এছাড়া, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৪৮২ কোটি ৪০ লাখ, ঢাকা ব্যাংকের ২০৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৫৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৫ কোটি টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১০৩ কোটি ২২ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২১ কোটি ছয় লাখ টাকা।

কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত (উদ্বৃত্ত) অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রাখায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৭০ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬৫ হাজার ৩৬৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে মোট নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ৫৮২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তা ঋণ হিসেবে বিতরণ করে থাকে। আমানতকারীদের এই অর্থ যেন ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সে জন্য প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে শূন্য দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের (এসএমই) বিপরীতে সবচেয়ে কম শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ আর ক্রেডিট কার্ডে রাখতে হয় সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ প্রভিশন।

এছাড়া নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে প্রভিশনিং করা হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। তবে বর্তমানে অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ডেফারাল সুবিধা নিয়ে দেরিতে প্রভিশন সংরক্ষণ করছে।

এদিকে মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে বিশেষ সুযোগ নিয়ে বছরজুড়ে কিস্তি না দিয়েও যেসব ঋণ খেলাপি হওয়া থেকে ছাড় পেয়েছে, সেসব ঋণের বিপরীতে এখন অতিরিক্ত ১ শতাংশ প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করতে গত ডিসেম্বরে নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.