শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষতি পোষাতে টিআইবির ৯ সুপারিশ

করোনা মহামারিতে তরুণদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে ব্যাপক ক্ষতি পোষাতে নয় দফা সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

এতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ অতিমারিতে দীর্ঘদিন স্বশরীরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে থাকা, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা এবং ভবিষ্যত কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জে দেশের তরুণ সমাজ মানসিক ও আর্থ-সামাজিক গভীর সংকটপূর্ণ সময় পার করছে।

পরিস্থিতি বিবেচনায় যুব জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও ভবিষ্যত কর্মসংস্থান নিশ্চিতে দ্রুত ও কার্যকর মনোযোগ ও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে টিআইবি। অতিমারিকালে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নয়টি সুপারিশ করে সংস্থাটি।

আজ বুধবার (১১ আগস্ট) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব সুপারিশের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।

আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষে পাঠানো ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে করোনা অতিমারির কারণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার ১৬ মাস পার হলেও সেগুলো খোলার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সমন্বিত ও কার্যকর কোনো কর্মপরিকল্পনা নেওয়া যায়নি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাসের চেষ্টা করা হলেও কারিগরি দক্ষতা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে তা অনেকাংশেই সফল হয়নি। বরং এটি শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন এক বৈষম্যের মুখোমুখি করেছে। বেশ কিছু গবেষণা বলছে, গ্রামাঞ্চলের ৬৩ শতাংশ পরিবারের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নেই এবং ব্যবহারের দক্ষতা নেই ৮৭ শতাংশ পরিবারের। ফলে গ্রামীণ ও আদিবাসী শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। এতে ধনী-গরিব ও শহর-গ্রামের মধ্যে শিক্ষা পাবার সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট হয়েছে; যা মোকাবিলায় কার্যকর কোনো সরকারি উদ্যোগ এখনও দৃশ্যমান নয়। এটি সত্যিই হতাশার।

দীর্ঘসময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং অতিমারির প্রভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, সাম্প্রতিক কয়েকটি গবেষণার তথ্যানুযায়ী অতিমারির থাবায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যথাক্রমে ১৯ ও ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে।

‘অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশংকায় বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে আশংকাজনক হারে (২৬%)। বিপুল সংখ্যক এই শিক্ষার্থীদের কিভাবে আবারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা হবে? আদৌ ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা? সেটি নিয়েও কারো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, শিক্ষাখাতের নতুন এসব চ্যালঞ্জে মোকাবিলায় নতুন করে যে বাড়তি বিনিয়োগ বা সহায়তা প্রয়োজন তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কোনো বরাদ্দ এখনও দৃশ্যমান নয়, যাকে অপিরনামদর্শী বলাটা মোটেও বাহুল্য হবে না।

অতিমারিতে যুব বেকারত্ব বেড়ে যাবার শঙ্কা সত্যি হতে চলেছে উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, অতিমারির প্রভাবে গত বছরই যুব-বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হওয়ার যে আশঙ্কা আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা করেছিলো, এতদিনে তা আরও বেড়েছে এটি অনায়াসে বলা যায়।

তিনি আরও বলেন, অতিমারিতে কাজ হারানো মানুষের বড় অংশই তরুণ ও যুবক; এদের বেশিরভাগই আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী- যাদের জন্য সরকারি উদ্যোগে পরিকল্পিত বড় ধরণের কোনো সহায়তা এখনও অনুপস্থিত।

‘শুধু চাকরি হারানোই নয়, অতিমারি চাকরি বাজারে নতুন ধরনের পরিবর্তনও নিয়ে এসেছে, যেখানে খাপ খাওয়াতে প্রযুক্তিগত ও কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন বেড়েছে ব্যাপকভাবে। নতুন এসব দক্ষতা অর্জনে যথাযথ শিক্ষার আয়োজন দ্রুত সময়ে করা না গেলে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা আরও প্রকট হবে, যা যুব সমাজকে দীর্ঘমেয়াদে হতাশার দিকে ঠেলে দেবে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার পাশাপাশি অর্থনীতিতে যুব শ্রমশক্তির ইতিবাচক অবস্থানকেও নড়বড়ে করে দেবে।’

করোনাসৃষ্ট সংকটের পাশাপাশি বিভিন্ন আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগে রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তরুণ-যুবকদের অংশগ্রহণ সীমিত হচ্ছে মন্তব্য করে ড. জামান বলেন, করোনা সংকটে বহু তরুণ স্বেচ্ছাসেবার অনন্য নজির স্থাপন করলেও অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন উদ্যোগে বাধা প্রদানের খবর পাওয়া গেছে।

এছাড়া রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগে স্বাধীন মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নীতি-কৌশল কিংবা রাজনৈতিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ইস্যুতে মন্তব্য বা মত প্রকাশের দায়ে মামলা ও আটকের ঘটনায় যুবসমাজের ওপর বেশি প্রভাব পড়েছে। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ইস্যুতে তরুণ-যুবকদের অংশগ্রহণ ও মত প্রকাশ সীমিত ও সংকুচিত হচ্ছে, যা আতঙ্কজনক।

অতিমারির এই সময়ে তরুণদের শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও স্বাধীন মতপ্রকাশ নিশ্চিত করতে টিআইবির সুপারিশগুলো হলো—
১. শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে কোভিড-১৯ এর টিকাদান করে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে অতিদ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দিতে হবে।

২. স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কার্যক্রম নিশ্চিত করে পরবর্তী স্তরে উত্তরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

৩. ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে, নারী, প্রতিবন্ধী, আর্থিকভাবে অসচ্ছল, আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

৪. স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে তরুণদের যথাযথ কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে।

৫. তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনার পাশাপাশি করোনায় যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাত থেকে তরুণরা কর্মহীন হয়েছে বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে সেগুলো চালুর উদ্যোগ নিতে হবে।

৬. কারিগরি ও বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিকল্প পেশার (যেমন আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং) জন্য কর্মহীন তরুণ বা নতুন গ্র্যাজুয়েটদের প্রস্তুত করতে হবে।

৭. সরকারি-বেসরকারি যেসব চাকরির পরীক্ষা ও নিয়োগ বন্ধ রয়েছে অবিলম্বে সেগুলোর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এবং নতুন বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে কোভিড অতিমারির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার মানদন্ড নির্ধারণ করতে হবে।

৮. সব চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতিমুক্ত রেখে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সমান প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।

৯. তরুণসমাজসহ সব নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য আইনি ও নীতিকাঠামোর প্রয়োজনীয় আমূল সংস্কার করতে হবে।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.