ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা

নামে-বেনামে অনিয়মে ঋণ বিতরণ ঠেকাতে নতুন করে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন করে ঋণ দিতে হলে ব্যাংকটির আমানত বৃদ্ধি ও বিতরণ করা ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া ব্যাংকটি নতুন কোনো সিনিয়র কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে পারবে না। এ ছাড়া শীর্ষ গ্রাহকদের ঋণ আদায়ে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত সোমবার ন্যাশনাল ব্যাংককে এই নির্দেশনা দিয়েছে।

আজ বুধবার (০৫ মে) বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহ্ সৈয়দ আব্দুল বারী। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। এর বেশি কিছু এখন বলতে পারব না।

ন্যাশনাল ব্যাংকে পাঠানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) ৮৭ শতাংশে না আসা পর্যন্ত ব্যাংকটি কোনো ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। বর্তমানে ব্যাংকটির এডিআর অনুপাত ৯২ শতাংশ। ব্যাংকটির আমানত প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা ও ঋণ ৪১ হাজার কোটি টাকা। তাই নতুন ঋণ বিতরণ করতে হলে ব্যাংকটির আমানত বৃদ্ধি ও বিতরণ করা ঋণ আদায় বাড়াতে হবে।

এছাড়া পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ব্যাংকটি অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ঋণ অধিগ্রহণ বা সম্পত্তি কিনতে পারবে না।

এর মাধ্যমে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংককে নিয়মে ফেরাতে চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ন্যাশনাল ব্যাংকের বিষয়ে অতীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এমন সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। এর আগে শেষ চেষ্টা হিসেবে শেষ মুহূর্তে বেসিক ব্যাংক ও সাবেক ফারমার্স (এখন পদ্মা) ব্যাংকের ক্ষেত্রে একই উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক দুটিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। এখন ন্যাশনাল ব্যাংকের বিষয়ে একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

ব্যাংকটির শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার ঋণ আদায়ের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, ব্যাংকটির শীর্ষ ২০ গ্রাহকের মধ্যে অন্যতম হলো এস আলম গ্রুপ, মায়শা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সাদ মুসা, নাফ ট্রেডিং, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, এফএমসি ডকইয়ার্ড, প্রাণ-আরএফএল, ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল, ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, ন্যাশনাল ব্যাংক উপদেষ্টা, পরামর্শক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিম্নতর দুই পদে নিয়োগ দিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। এর ফলে ব্যাংকটিতে শীর্ষ পর্যায়ে পছন্দের ব্যক্তি চাইলেই নিয়োগ দিতে পারবে না।

এদিকে ঋণ বিতরণে অনিয়ম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) না থাকা, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরিচালনা পর্ষদে শুরু হয় বিবাদ- সব মিলিয়ে অস্থির অবস্থায় ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে স্থায়ী এমডি নিয়োগের সময় বেঁধে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসময় এমডি নিয়োগ না দিলে আইন অনুযায়ী প্রশাসক বসানো হবে জানিয়েছিল। পরে জরুরি বোর্ড সভা ডেকে শাহ্ সৈয়দ আব্দুল বারীকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেয় ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। সৈয়দ আব্দুল বারীকে তিন মাসের জন্য অনাপত্তি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিনি এসময় ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন। আর ব্যাংকের পর্ষদ আগামী তিন মাসের মধ্যে স্থায়ী এমডি নির্বাচন করবে।

এর আগে দীর্ঘদিন ব্যাংকটির অতিরিক্ত এমডি এ এস এম বুলবুল এমডির চলতি দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাকে সরিয়ে দিতে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ন্যাশনাল ব্যাংকের দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার গত ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর কোনো পর্ষদ সভা না হলেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়, যার সুবিধাভোগী নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর মূলত তার ছেলেরা ব্যাংকটি পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন ব্যাংকটির কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাও। এ নিয়ে সিকদার পরিবার ও ব্যাংকটির পরিচালকদের মধ্যে বিভক্তি প্রকট হয় গত ১২ ফেব্রুয়ারির পরিচালনা পর্ষদে। সেদিন নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে বিতরণ করা ঋণের অনুমোদনের প্রস্তাব উঠলে তার মেয়ে ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পারভীন হক সিকদার বিরোধিতা করেন। তাকে সমর্থন দেন সিকদার পরিবারের বাইরের পরিচালকেরাও। ফলে এসব ঋণ আর অনুমোদিত হয়নি।

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার, পরিচালকদের মধ্যে দুই ছেলে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার এবং সিকদার গ্রুপের কর্মকর্তা নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া ও বদিউল আলম এক পক্ষে আছেন। আর বিপরীতে অবস্থানে থাকা পারভীন হক সিকদারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিচ্ছেন কেডিএস গ্রুপের খলিলুর রহমান, হোসাফ গ্রুপের মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাবরুর হোসেন এবং জাকারিয়া তাহের। তারা চাইছেন ব্যাংকটিতে নতুন করে আর অনিয়ম না হোক। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিশেষ পরিদর্শন অব্যাহত রেখেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংকে দীর্ঘদিন এমডি নেই। এখন শুধু তিন মাসের জন্য এমডি নিয়োগ দিয়েছে। ব্যাংকের কিছু পরিচালক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন। এই কারণে ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞাসহ বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে নিশ্চয়ই এসব তুলে নেওয়া হবে। তবে আগে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে।

ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ব্যাংকটি নতুন করে ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। পাশাপাশি সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ১১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ঋণের ওপর প্রথম প্রান্তিকে সুদ যুক্ত হয়েছে ৬৫০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। তবে তিন মাসে আমানত বেড়েছে মাত্র ৫২১ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকটির ৪০টি শাখা লোকসানে রয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে ফেসভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.