‘কেবল ভাবছিলাম, কতক্ষণ পর মারা যাব’

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এদিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত এবং এক কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়।

নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ৯১-এর এই ঘূর্ণিঝড় একটি। ৯১-এর এই ভয়াল ঘটনা এখনও দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় উপকূলবাসীকে। ঘটনার এত বছর পরও স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না সেই দুঃসহ দিনটি। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় জলোচ্ছ্বাস আর ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে হলে। নিহতদের লাশ, স্বজন হারানোদের আর্তচিৎকার আর বিলাপ বার বার ফিরে আসে তাদের জীবনে।

লুৎফুননাহার সেই রাতের কথা এখনো ভোলেননি। লুৎফুননাহারের বাড়ি ছিল কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নে। এলাকাটি বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা। বয়স তখন ১৩, স্কুলে পড়েন। আজও স্মরণ করতে পারেন, দিনটি মেঘলা ছিল। বয়স্করা বলছিল, বড় ঝড় হতে পারে। কিন্তু সে ঝড় যে এমন প্রলয়ংকরী হবে, তা ভেবেছিল কে।

রাত বাড়তেই ঝোড়ো হাওয়া বাড়তে থাকে। উথালপাতাল সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে জনপদে। পরিবারের সবাই টিনের ঘরের ওপর আশ্রয় নেন। দেখেন, পানির তোড়ে একের পর এক বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে পানির ধাক্কা লাগে তাঁদের ঘরেও। পানিতে ডুবে হাবুডুবু খেতে খেতে এক নারকেলগাছ আঁকড়ে ধরেন এখন কক্সবাজার শহরে থাকা দুই সন্তানের এই মা। কিন্তু পানির তোড়ে ঘর থেকে খুলে আসা এক টিনের ধাক্কা লাগে শরীরে। ক্ষতবিক্ষত হয় শরীর। ঢেউয়ের মধ্যে পড়ে যান। এরপর সারা রাত পানির সঙ্গে লড়াই।

গৃহিণী লুৎফুননাহারের সে ঘটনা মনে হলে আজও আতকে ওঠেন। ভয়ার্ত কণ্ঠে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘একটার পর একটা ঢেউ আসে। বাড়ির সবাই কই গেল, তখন আর কিছু মনে নাই। কেবল ভাবছিলাম, কতক্ষণ পর মারা যাব।’

ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে সেদিনের সেই কিশোরীর দেহটি আটকে যায় পাশের ইউনিয়ন মাতারবাড়ীর একটি চরে। সকালের দিকে একদল লোক এসে মনে করেছিল, লাশ পড়ে আছে। কিন্তু মেয়েটি বেঁচে আছেন দেখে আশ্চর্য হয় সবাই। আহত, বিপর্যস্ত কিশোরীকে নিয়ে যাওয়া হয় মহেশখালীর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তিন দিন পর বাড়ির কিশোরীটি বাড়িও ফিরেছিল। কিন্তু ভাই, ভাবি, তার ৪ সন্তান, ফুফুসহ ১৮ জনকে ১৯৯১–এর সেই ভয়াল রাতের ঘূর্ণিঝড় কেড়ে নিয়েছিল। কিশোরী এর কিছুই জানত না। সেই রাতে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগার ফলে বুকের ব্যথা আজও কষ্ট দেয়। বেশি কষ্ট স্বজন হারানোর।

ধলঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান তখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। ঝড়ের স্মৃতি তার স্মৃতিতে এখনো ভাসে। কামরুল বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের এক-তৃতীয়াংশের বেশি ওই এক রাতে মারা গেছে। এমন কোনো পরিবার নেই যে স্বজনহারা হয়নি। একটিও স্থাপনা অক্ষত ছিল না। আর সেবার দুটো ওয়ার্ড সমুদ্রগর্ভে চলে যায়।’

পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়টি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ছয় মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয় এবং এতে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারান।

এদের বেশিরভাগই নিহত হয় চট্টগ্রাম জেলার উপকূল ও দ্বীপসমূহে। সন্দ্বীপ, মহেশখালী, হাতিয়া দ্বীপে নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। শুধু সন্দ্বীপেই মারা যায় প্রায় ২৩ হাজার লোক।

ধারণা করা হয়, এই ঘুর্ণিঝড়ের কারণে প্রায় এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। সাগর ও নদীর উপকূল প্লাবিত হয়। কর্ণফুলী নদীর তীরে কংক্রিটের বাঁধ থাকলেও এটি জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১০০ টন ওজনের একটি ক্রেন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে স্থানচ্যুত হয় এবং আঘাতের কারণে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান নিখোঁজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক যানও ছিল। এছাড়া প্রায় ১০ লাখ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.