করোনার সঙ্গে এক বছর, যা হারালাম

ঠিক এক বছর আগে ২০২০ সালের ৮ মার্চ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রথমবারের মতো জানায়, বাংলাদেশে দুজন পুরুষ ও একজন নারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।

এরপর গত এক বছরে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে করোনা ও এর পারিপার্শ্বিক থাবায়। প্রথম দিকে মানুষের ছিল উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, ভাইরাস সম্পর্কে তথ্য না থাকা, গুজব, কোন ওষুধ বা টিকা না থাকা সব মিলিয়ে দিশেহারা অবস্থা। মানুষকে ঘরবন্দি থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন, কোথাও কোথাও হয়েছে লকডাউন।

অন্যান্য দেশের মতো জাতিসংঘের নির্দেশে মানুষের শুধু করণীয় ছিল বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এখন বছর পূর্তিতে ৩১ লাখের বেশি মানুষ নিয়েছে টিকা। কাজে ফিরেছে দেশের বেশির ভাগ মানুষই।

এই এক বছরে সরকারি হিসেবে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ লাখ ৫০ হাজার ৩৩০ জন। মারা গেছেন ৮ হাজার ৪৬২ জন। সেরে উঠেছেন ৫ লাখ ৩ হাজার ৩ জন।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মার্চ মাসে কম সংখ্যক শনাক্ত ও মৃত্যু দিয়ে করোনার সংক্রমণ শুরু হলেও ধীরে ধীরে বাড়ে এপ্রিলে এবং এক লাফে বেড়ে যায় মে মাসে। মে থেকে শুরু করে জুন, জুলাই ও আগস্ট পর্যন্ত সেই ধারা অব্যাহত ছিল। তবে আগস্টের শেষে এসে সংক্রমণের হার কিছুটা নিম্নমুখী বলে ধারণা দেয় পরিসংখ্যান। দেশে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ২৩ জন করে মারা গেছে করোনার থাবায়। তবে বর্তমানে দৈনিক হিসেবে সেটি ১০ জনের মধ্যে নেমে এসেছে।

রাজধানীর টোলারবাগের যে বাড়ি থেকে শুরু করোনার মৃত্যুর মিছিল, সেসব দিন মনে হলে এখনো আতঙ্কে জমে যান এখানকার মানুষ। দুঃসহ স্মৃতি কিছুটা মলিন হলেও বেদনা কি ভুলতে পেরেছেন তারা?

হাজী আবদুর রহিম নাম একজন গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথম মৃত্যু ও দ্বিতীয় মৃত্যু আমাদের ঘরে। সেই সময়ে আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পেতাম। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক।

দেশের প্রথম লকডাউন রাজধানীর উত্তর টোলারবাগ এলাকার জীবন এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। ওই এলাকার বাসিন্দারা জানান, আল্লাহর রহমতে করোনা অনেকটা কমে গেছে। এখানকার জীবনযাপন এখন অনেকটা স্বাভাবিক।

দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আগে থেকেই জনমনে ক্ষোভ ছিল। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সেটা আরও জোরালো হয়। উঠে আসে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির নানা চিত্রও। শুরুতে সমন্বয়হীনতা প্রকট আকার ধারণ করে। যার কারণে দেশজুড়ে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

শুরুর আড়াই মাস কাজে লাগাতে পারেনি মন্ত্রণালয়। উল্টো চিকিৎসকদের দেওয়া হয় নিম্নমানের পিপিই। সুরক্ষা উপকরণ কেনাকাটায় ধরা পড়ে দুর্নীতি। অনুমোদনহীন হাসপাতালকে করা হয় করোনার জন্য ডেডিকেটেড। এসব কারণে প্রায় প্রতিদিনই রোগী থেকে আক্রান্ত হয়েছেন চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। লকডাউন করতে হয়েছে পুরো হাসপাতাল। শুরুর দিকে নমুনা পরীক্ষা, রিপোর্ট দিতে দেরি করা, নমুনা পরীক্ষায় রোগীর ভোগান্তি; মোটকথা, করোনা ব্যবস্থাপনার আগাগোড়া ছিল প্রশ্নের মুখে।

নকল মাস্ক সরবরাহের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ায় বিব্রত হয় কেন্দ্রীয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে চিকিৎসকদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি বলেও জানায় চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।

করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা, চিকিৎসা, নকল রিপোর্ট নিয়ে হাসপাতালের জালিয়াতিতে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বোচ্চ পদে রদবদল হয়। মহামারির সময়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ায় মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর। বদল হয় স্বাস্থ্য সচিব এবং স্বাস্থ্যের মহাপরিচালকের পদ।

শুরুতে সংকট ছিল ভেন্টিলেটর, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, অক্সিজেন সিলিন্ডার, আইসিইউ শয্যাসহ জরুরি সব চিকিৎসা সামগ্রীর। যদিও ধীরে ধীরে এসব সংকট কাটিয়ে ওঠে বাংলাদেশ।

বছর পার হলেও এখনো যায়নি করোনা। ক্ষত কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও এখনো সবকিছু স্বাভাবিক হতে পারেনি। অনেকে হারিয়েছেন স্বজন, অনেকে হারিয়েছেন কাজ। তারপরও সরকারের কল্যাণমুখী নানা উদ্যোগের ফলে ক্ষতি কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। বছর শেষে তাই মানুষের প্রত্যাশা করোনামুক্ত এক সকালের।

অর্থসূচক/কেএসআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.