পাকিস্তানের সেনা প্রধানের সঙ্গে দুই ঘণ্টা বৈঠকে ইরান প্রসঙ্গ প্রাধান্য পায় বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। মুনিরের সঙ্গে ট্রাম্পের আলোচনায় উঠে আসে ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা, যেখানে সেনাপ্রধান আশা করেন, যুক্তরাষ্ট্র যেন ইসরায়েলের যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে এবং তিনি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।
কারণ, তেহরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের একটি অংশ ইরানের স্বার্থ রক্ষা করে।
পাকিস্তান ইরানের ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলার নিন্দা জানিয়ে একে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে।
হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে স্বাগত জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। তাদের এ বৈঠক দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক বিরোধ ও মধ্যস্ততাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে।
ট্রাম্প বলেন, তিনি ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সম্মানিত বোধ করেছেন এবং তারা ইরান নিয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা’ করেছেন। প্রেসিডেন্টের ভাষায়, ইরান সম্পর্কে পাকিস্তানের বোঝাপড়া অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক ভালো।
তবে এই বৈঠক শুধু ইরান প্রসঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল না। এতে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ট্রাম্প পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত ঐক্য ও পারস্পরিক স্বার্থভিত্তিক বাণিজ্য অংশীদারত্ব গড়ে তোলার ব্যাপারে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন, বলে জানিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
এই মধ্যাহ্নভোজ-ভিত্তিক বৈঠকটি ছিল প্রথমবারের মতো, যেখানে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান জ্যেষ্ঠ বেসামরিক পাকিস্তানি কর্মকর্তার উপস্থিতি ছাড়াই। এটি কূটনৈতিক রীতির ব্যতিক্রম এবং স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়—পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর কতটা প্রভাব রয়েছে।
তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে ট্রাম্পের করা মধ্যস্থতার দাবি। ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানান, তিনি মুনিরকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ থামানোর জন্য ধন্যবাদ জানান এবং একইসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও প্রশংসা করেন। ট্রাম্প গত মঙ্গলবার মোদির সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও জানান।
ট্রাম্প বলেন, ‘দুই জন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি সেই যুদ্ধ চালিয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; যা পারমাণবিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারত।’
ট্রাম্প আরও দাবি করেন, ‘আমি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছি। এই মানুষটি (মুনির) পাকিস্তানের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, মোদি ভারতের পক্ষ থেকে, এবং আরও কয়েকজন। তারা একে অপরকে আক্রমণ করছিল—আর দু’দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। আমি সেটা থামিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি একটা যুদ্ধ থামিয়েছি… আমি পাকিস্তানকে ভালোবাসি। আমি মনে করি মোদি একজন অসাধারণ মানুষ। আমরা ভারতের মোদির সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করব।’
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আনা কেলি জানান, ট্রাম্প মুনিরকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেন তখন, যখন মুনির তাকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ রুখে দেওয়ার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়নের আহ্বান জানান।
তবে ভারত এই মধ্যস্থতার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারতের প্রধান কূটনীতিক পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্পষ্টভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে জানান, ওই সময়কালে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তি কিংবা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে মার্কিন মধ্যস্থতা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
তিনি বলেন, ‘সেনা অভিযান বন্ধের আলোচনা হয়েছে সরাসরি ভারত ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান সামরিক চ্যানেল ব্যবহার করে এবং পাকিস্তানের অনুরোধে। ভারত অতীতেও কখনও মধ্যস্থতা মানেনি, ভবিষ্যতেও কখনও মেনে নেবে না।’
মিশ্রি আরও জানান, মোদি ও ট্রাম্পের জি-৭ সম্মেলনের সাইডলাইনে সাক্ষাৎ হওয়ার কথা থাকলেও, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির কারণে ট্রাম্প এক দিন আগেই কানাডা ত্যাগ করেন।
ট্রাম্প মোদিকে অনুরোধ করেছিলেন কানাডা থেকে ফেরার পথে যুক্তরাষ্ট্রে থামতে, কিন্তু মোদি পূর্বনির্ধারিত ব্যস্ত সূচির কারণে তা সম্ভব নয় বলে জানান।
গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ শুরু হয় ২২ এপ্রিল, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এক হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর। নয়াদিল্লি অভিযোগ করে, হামলাটি পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসীরা চালিয়েছে, যদিও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করেছে।
পাকিস্তান বলেছে, যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু হয় তখন, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রথমে ফোন করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার জবাব দেয়।
৭ মে, ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের ভেতরে ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায়, যার ফলে চার দিনব্যাপী পাল্টাপাল্টি হামলা শুরু হয়।
এই সংঘাতে দুই দেশই যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং আর্টিলারি ব্যবহার করে—পরিস্থিতি পৌঁছায় চরম উত্তেজনায়।
এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশন থিঙ্ক ট্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘দিল্লির জন্য এটি সেই পুরনো প্রশ্নেই এসে ঠেকে: যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সহযোগিতা কতটা সহ্য করা যায়—যাতে তা যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত না করে?’
তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি ট্রাম্প কাশ্মীর বা যুদ্ধবিরতি নিয়ে মার্কিন ভূমিকায় মন্তব্য করতে থাকেন, তবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
কারণ, কাশ্মীর ইস্যু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল বিরোধপূর্ণ অঞ্চল—যার দাবি উভয় দেশই করে।
অর্থসূচক/
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.