উদীচী’র পতাকার রূপকার শিল্পী আনোয়ার হোসেনের জন্মবার্ষিকী উদযাপন

নাচ-গান-আবৃত্তিসহ বর্ণিল আয়োজনে উদীচী’র পতাকার রূপকার এবং সাবেক সহ-সভাপতি, স্বাধীনতার প্রাক্কালে চারুশিল্পীদের নানা সফল আন্দোলনের বলিষ্ঠ সংগঠক, শিল্পী আনোয়ার হোসেনের ৮০ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

এ উপলক্ষে সোমবার (১ জানুয়ারি) শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত, আবৃত্তি ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় উদযাপন অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই নাচের তালে তালে শিল্পী আনোয়ার হোসেনকে মঞ্চে নিয়ে যান স্পন্দনের শিল্পীরা। এরপর উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা পর্ব। এ পর্বের  শুরুতে শিল্পীকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন অধ্যাপক বদিউর রহমান। তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতিরা। উপহার সামগ্রী তুলে দেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি শিবানী ভট্টাচার্য্য।

এরপর আলোচনায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনে শিল্পী আনোয়ার হোসেনের নানা অবদানের কথা তুলে ধরেন শিল্পী মোনায়েম সরকার, আব্দুল মান্নান, মতলুব আলী, সংস্কৃতিজন রফিউর রাব্বী ও মাহফুজা খানম, সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, উদীচীর সাবেক দুই সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ সেলিম ও রেজাউল করিম সিদ্দিকী রানা এবং শিল্পী আনোয়ার হোসেনের সহধর্মিনী শিমু আনোয়ার। আলোচনা পর্বটি সঞ্চালনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে। বক্তারা জানান, পাকিস্তানের স্বৈরাচার আইয়ুব খানের শাসনামলে ঢাকা আর্ট স্কুলকে আর্ট কলেজে রূপান্তর আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী ছিলেন শিল্পী আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক চীফ ডিজাইনার থাকা অবস্থায় তিনি বেশ কিছু নতুন বিষয় পরিচয় করান।

আলোচনার পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্ব। এ পর্বে শিল্পী আনোয়ার হোসেনের জীবন বৃত্তান্ত পাঠ করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি, বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী, বেলায়েত হোসেন। “ওরে ওরে বঞ্চিত সবহারা দল” এবং “কোন আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে” গান দুটি দলীয়ভাবে পরিবেশন করেন উদীচীর সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম ও কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুরাইয়া পারভীন। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন বরেণ্য বাচিক শিল্পী ভাস্বর বন্দোপাধ্যায় ও উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য শিখা সেন গুপ্তা। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের নৃত্যশিল্পীরা।

১৯৪৩ সালের ০১ জানুয়ারি মাদারীপুরের পালং এ জন্ম নেয়া শিল্পী আনোয়ার হোসেন একজন শিল্পে সমর্পিত বরেণ্য চিত্রশিল্পী। ১৯৫৯ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত চারুকলা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। প্রতিষ্ঠানটিকে স্কুল থেকে কলেজে রূপান্তরিত করার জন্য আন্দোলনে নামেন এবং ছাত্রদের সংগঠিত করেন। ১৯৬৪ সালে এই কলেজ থেকে বি. ফ. এ সম সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে আসেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য কিছু ভূমিকা রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ১৯৭১ এ স্বাধীনতার প্রাক্কালে গঠিত ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ এর সক্রিয় কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন ও চারুশিল্পীদের সংগঠিত করা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ভাঙ্গা বিচূর্ণ শহীদ মিনারের বাঁকা রডের মাথায় শহীদুল ইসলামকে সাথে নিয়ে তিনিই প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দেন।

স্বাধীনতার পরপরই কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তীর অনুপ্রেরণায় তিনি যুক্ত হন উদীচীর সাথে। যুক্ত হওয়ার পর তিনি উদীচীর শোভাযাত্রার ধরন পাল্টে দেন। এঁকে ফেলেন উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেনের প্রতিকৃতি। শোভাযাত্রায় ফেস্টুনে আরো শোভা পেত মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী, প্রয়াত শিল্পী-সাহিত্যিক ও খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের প্রতিকৃতি। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যেমন একটি পতাকা পেয়েছে উদীচীর জন্যেও তেমন একটি পতাকার চাহিদা দেখা দিলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এঁকে দেন সে পতাকার নকশা। ৪ ফুট বাই ৬ ফুট আকৃতির পতাকার ভেতরে “স্বাধীনতাযুদ্ধে লক্ষ প্রাণের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া টকটকে লাল সূর্য, তার পেছনে শান্তির শুভ্রতা এবং নীচে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত লাল জমিন” এমনি এক অর্থপূর্ণ পতাকার নকশা করে দেন তিনি।

 

অর্থসূচক/ এইচএআই

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.