হরতাল-অবরোধে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ার শঙ্কা

প্রায় চার বছর পর হরতাল অবরোধের মত কর্মসূচির কবলে পড়েছে দেশ। এসব কর্মসূচির কারণে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। শিল্পের কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না। কৃষি পণ্যের সরবরাহে ব্যাঘাত হচ্ছে। বন্দরে কমে গেছে কন্টেইনার উঠানো-নামানোর সংখ্যা। রাজপথে রাজনৈতিক সংঘাত চলতে থাকলে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। এর ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ব্যাপক চাপে পড়বে। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা।

বৈশ্বিক সংকটে দেশের অর্থনীতি আগে থেকেই ব্যাপক চাপে রয়েছে। সংকটের মধ্যে থাকা অর্থনীতিতে বড় আশঙ্কা তৈরি করছে হরতাল অবরোধের সংঘাত। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে এধরনের সংঘাত আরো চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন মজুমদার অর্থসূচককে বলেন, ব্যাংক খাতে ঋণ খেলাপিদের মধ্যে অনেকে ইচ্ছাকৃত। তারা এমন রাজনৈতিক অস্থিরতাকে উসিলা হিসেবে ব্যবহার করবে। এর ফলে তারা আরও সুযোগ নিবে। এছাড়া রাজনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্যমে স্বাভাবিক কার্যক্রম কতটুকু বাধাগ্রস্থ হবে তার উপর নির্ভর করবে খাতটির খেলাপি বৃদ্ধির বিষয়টি।

এর আগে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিলো বিএনপি। এরপর ২০১৫ সালে ওই নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে টানা তিন মাস হরতাল-অবরোধ পালন করে দলটি। ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেও ভালো যায়নি ২০১৫ সাল। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ পরিবেশ ভাল না থাকায় উদ্যোক্তারা ব্যাংক বিমুখ হয়ে পড়েন।

এর ফলে সে বছরের পুরোটা সময় ব্যাংক খাত অলস টাকার যন্ত্রণায় ভুগেছে। ব্যাংকগুলোকে একদিকে আমানতে সুদ গুনতে হয়েছিল, অন্যদিকে নতুন কোনও প্রকল্পে ঋণও দিতে পারেনি। অপরদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে না পারায় আগের নেওয়া ঋণ ফেরত দিতে পারেনি অনেকে। এতে ব্যাংকিং খাতের খেলাপির পরিমাণ বেড়েছিলো।

তখন এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছিলো ব্যাংকের। আর খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে নিট আয়ে বড় প্রভাব পড়ছিলো খাতটিতে।

জানা যায়, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপির পরিমাণ ছিলো ৫৪ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ৯ মাসের ব্যবধানে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছিলো ৪ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। আর জুন প্রান্তিকে চেয়ে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি বেড়েছিলো ২ হাজার ১৯২ কোটি টাকা।

এর আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি দাঁড়িয়েছিলো ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। এরপরে এক বছরে খেলাপি বেড়েছিলো ৯ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। কারণ সেবছরও ছিলো নির্বাচনী অস্থিরতা। এর ফলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা।

এরপর বিরোধী দল বিএনপি হরতাল করেছিলো ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। তখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সর্বশেষ হরতাল দিয়েছিল দলটি। আর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ২০২০ সালের দোসরা ফেব্রুয়ারি হরতাল ডেকেছিলো বিএনপি।

পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নিজেদের মহাসমাবেশে হামলার অভিযোগ করে দেশজুড়ে গত রোববার (২৯ অক্টোবর) সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিলো বিএনপি। এর মাধ্যমে প্রায় ৪ বছর পর আবারো হরতাল কর্মসূচিতে ফিরেছে বিরোধী দল বিএনপি। এরপর একদিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে টানা তিনদিনের অবরোধ পালন করেছে দলটি।

হরতাল-অবরোধে ব্যাংক খাতের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিবার হরতাল অবরোধে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভাটা পড়ে। এর ফলে খাতটিতে সুদবহির্ভূত আয়ও কমে যায়। এর বিপরীতে ব্যাংক খাতের বাড়তে থাকে ব্যয়। এ কারণেই বেশিরভাগ ব্যাংক ব্যয় সাশ্রয়ের নীতি অবলম্বনের চেষ্টা করে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর পাশাপাশি লোকবলও কমিয়ে দেয় অনেকে। কিছু কিছু ব্যাংকে ছাঁটাইয়ের ঘটনাও ঘটে। এতে কর্মসংস্থানের উপরও ব্যাপক প্রভাব পড়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এর আগে গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। এ সময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ১ লাখ ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকাই শীর্ষ ১০ ব্যাংকে রয়েছে।

অর্থসূচক/সুলাইমান

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.