‘সকলকে নিয়ে স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে তোলা সম্ভব’

বুঝে শুনে পুঁজিবাজারে আসতে হবে। কারো কথায় প্ররোচিত হয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না। যারা অন্যের কথায় উত্সাহিত হয়ে বাজারে বিনিয়োগ করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সকলকে সাথে নিয়ে দেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নে কাজ করতে হবে। তবেই স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে তোলা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কমিশনার মো. আব্দুল হালিম।

বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহের অংশ হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড এবং ডিএসই ব্রোকারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে ডিএসই মাল্টিপারপাস হলে “Sustainable Practice and Untapped Investment Opportunities” শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাফিজ মুহম্মদ হাসান বাবু অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বে করেন। এছাড়া ডিবিএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সাজিদুল ইসলাম সঞ্চালনা করেন।

এছাড়া প্যানেল আলোচকের বক্তব্য দেন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, আইডিএলসি ফাইন্যান্সের এমডি সাইফুদ্দিন আহমেদ, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী এবং অদিতি হালদার।

কমিশনার আব্দুল হালিম বলেন, দেশের কয়েকটি জেলায় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি রয়েছে। নীলফামারী সহ উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারি অনেক কম। এসব জেলায় বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে বৃদ্ধি করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। একই সাথে এসব জেলায় নারী বিনিয়োগকারী আরো কম। তাদেরকে পুঁজিবাজারে আনার চেষ্টা করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার মুখি হবে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ভিশন স্মার্ট বাংলাদেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। এক্ষেএে দেশের পুঁজিবাজারের অনেক অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বুঝে শুনে বিনিয়োগ করতে হবে। বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদী হলে তা টেকসই হয়। আর সকল ধরনের বিনিয়োগকারীরা যাতে আইন অনুযায়ী ব্যবসা করতে পারে সে বিষয়ে আপনাদের খেয়াল রাখতে হবে।

আমরা সমাজে বৈষম্য চাইনা আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য সমাজ ব্যবস্থা চাই। দেশে আয়ের বৈর্ষম্য রয়েছে তবে টেকসই অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এ বৈষম্য দূর করতে হবে।

এছাড়াও তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ডলার। তবে যারা এখনো অনেক পিছিয়ে আছে তাদেরকে নিয়ে কাজ করা দরকার। কারণ টেকসই সমাজ তৈরি করতে হলে বৈষম্য দূর করতে হবে। সাসটেইনেবল বলতে দীর্ঘমেয়াদী সময়কে বোঝায়।

ডিবিএ’র প্রেসিডেন্ট রিচাড ডি রোজারিও বলেন, বিশ্বায়নের ফলে আজ ব্যবসা বাণিজ্যের প্রকৃতি ও ধরণ পাল্টেছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বিভিন্ন দেশের নানা শ্রেণী পেশার মানুষ বিনিয়োগের সুবিধা পেতে বাজারে আসছে। বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ফলে বাজারে পণ্য বৈচিত্র এসেছে। এরফলে যেমন বাজার বড় হচ্ছে তেমনি ঝুঁকির আশংকা তৈরি হচ্ছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্ষ্টি সকলের মাঝে বাড়তি সাবধানতা ও সতর্কতা থাকা দরকার।

এ ধরনের অনুষ্ঠনের আয়োজনের আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো কিভাবে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে পৃঁজিবাজারে লাভবান হওয়া যায়। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। তাই এখান থেকে প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে সেই মোতাবেক বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা এবং বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখার আহবান জানান তিনি।

মূল প্রবন্ধে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম তারিকুজ্জামান বলেন, কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি, বিজনেস সাসটেনেবিলিটি, সাসটেনেবিলিটি ডেভেলপমেন্ট গোলসমূহ, এনভারমেন্ট, সোশ্যাল এবং গর্ভান্যান্স (ইএসজি) প্রতিটি কোম্পানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি গ্লোবাল রিপোর্টিং ইনিশিয়েটিভস (জিআরআই), সাসটেনেবিলিটি প্রাকটিসের নীতি উদ্দেশ্য ও মূল উপাদান, টেকসই বিনিয়োগ ও অনুশীলনের সুবিধা, , ডিএসই-জিআরআই এর সহযোগিতা সহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি আলোচনা করেন। এছাড়া তিনি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বেশি করে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ নেয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের কথাও উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে নোকিয়া ও অ্যাপলের মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোও সাসটেইনেবলিটি রিপোর্ট তৈরি করে। কোম্পানিগুলো সমাজ, পরিবেশ এবং স্টেকহোল্ডারদের জন্য কাজ করে। তাই সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। আমরা যদি শূন্য শতাংশ কার্বন নির্গমন করি সেটা বিনিয়োগ ও সমাজের জন্য ভালো। এর ফলে বিনিয়োগের আগ্রহ বাড়ে।

ডিএসইর চেয়ারম্যান হাফিজ মুহম্মদ হাসান বাবু বলেন, টেকসই উন্নয়ন করতে গেলে স্থিতিশীল বিনিয়োগ দরকার, যেটি বর্তমান সরকার করে যাচ্ছে। যে কোনো দেশের বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করার আগে সুশাসনসহ বিভিন্ন বিষয় লক্ষ্য করেন। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগ আনতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের পুঁজিবাজারকে টেকসই করতে হবে। কারণ এর গুরুত্ব অনেক। এখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করতে হবে। এজন্য টেকসই অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দেশে এখন ২০৩টি গ্রীন কারখানা তৈরি হয়েছে। এসব কারখানায় বিপুল সংখ্যক বিদেশি ক্রেতা আসছেন। এছাড়া অন্য যেকোনো কারখানার তুলনায় গ্রীন কারখানায় বেশি কাজের অর্ডার দিচ্ছেন।

এছাড়াও তিনি বলেন, শুধু আইন দিয়ে নয় উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। পুঁজিবাজার স্থিতিশীল অর্থনীতি উন্নয়নে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, সামনের দিনগুলোতে বিনিয়োগের বড় সুযোগ আসতেছে। একইসঙ্গে ঝুঁকিও মোকাবেলা করতে হবে। তাই সাসটেইনেবল করতে হলে ব্যাপকভাবে সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো যদি দায়িত্ব নিয়ে ভালো মানের জিআরআই রিপোর্ট তৈরি করে, তাহলে এটা ঐ প্রতিষ্ঠানের জন্যই ভালো। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সহ যারা দায়িত্ব পালন করছে সবার লক্ষ্য বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। প্রতিষ্ঠানে গভর্নেন্স থাকতে হবে। পাশাপাশি পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।

সিএমজেএফ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেন, টেকসই বিনিয়োগকে উৎসাহ যোগাতে বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি কিছু প্রণোদনা প্রয়োজন। এর জন্য ইএসজি’র গ্রহণযোগ্য সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। আর এই সার্টিফিকেটধারী কোম্পানিগুলোর আইপিওর ক্ষেত্রে বিএসইসি কনসেন্ট ফি’তে ছাড় দিতে পারে; ডিএসই তার লিষ্টিং ফি কমাতে পারে।

তিনি বলেন, সাংবাদিকদের কাজ তথ্য পরিবেশন করা। টেকসই বিনিয়োগের বিষয়টি সবার সামনে তুলে ধরা উচিত। সাংবাদিকেরা যদি সবার দায়বদ্ধতা তুলে ধরে তাহলে রেগুলেটর ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজ করতে সুবিধা হয়। আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে গভর্নেন্সের অভাব রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বিএসইসি যখন কোনো কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয় তখনই খোঁজ নেওয়া দরকার। কোম্পানিটি কি পণ্য তৈরি করছে ও কিভাবে চলছে এবিষয়ে অবশ্যই খোঁজ নেওয়া উচিত। টেকসই অর্থনীতি ও পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে শুরুতেই নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা থেকে কাজ করতে হবে। কারণ আমাদের দেশ থেকে কম গ্রীনহাউস নির্গমন হয়। এরপরও সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী আমরা। পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে অল্প বৃষ্টিতেই বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যেতে দেখছি। সিমেন্ট কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে ওঠার কারণে সেখানকার মাছ সহ অন্যান্য প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এছাড়া শাকিল রিজভী বলেন, ডিএসই ইতিমধ্যে একটি গ্রিন বন্ড চালু করেছে। এছাড়া বাংলাদেশে বর্তমানে ২০৩টি গ্রীন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রয়েছে। পুঁজিবাজারে গ্রীন ফ্যাক্টরি তালিকাভুক্ত করতে আলোচনা চলছে। ডিএসইর আজকের এই সেমিনারও টেকসই পরিবেশ তৈরির চেষ্টা। ব্যাপকভাবে পরিবেশ ও সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি নিয়ে কাজ করতে হবে। সুশাসন ও সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি ফিরে আসুক সেই প্রত্যাশা করেন তিনি।

অদিতি হালদার বলেন, গ্লেবাল রিপোর্টিং ইনিশিয়েটিভ (জিআরআই) ১৯৯৭ সালে শুরু করেছিলাম। জিআরআই স্টান্ডার্ড বিনিয়োগকারীরা সহ সবাই ফ্রিতে ব্যবহার করতে পারে। অনেক দেশের রেগুলেটরের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর সঙ্গে ভালোভাবেই কাজ করছি। জিআরআইর মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিনিয়োগকারীরা ধারণা পেতে সক্ষম হয়। ব্যবসায় ভালো করতে পারলে সবার আগে দেশের অর্থনীতির উন্নতি হয়। তাই এক্ষেত্রে জিআরআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

অর্থসূচক/এমএইচ/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.