‘পুঁজিবাজারের মতো বন্ড ও ট্রেজারি বিলের লেনদেনে সুযোগ দরকার’

ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মার্কেটিং আরও ডিজিটাল করা দরকার। পাশাপাশি পুঁজিবাজারে যেরকম প্রতিদিন কেনাকাটা হয়, সেরকমভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিৎ বন্ড ও ট্রেজারি বিলের লেনদেনের সুযোগ দেওয়া। এতে সবাই আরও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারতো বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান।

রোববার (৯ জুলাই) রাজধানীর কারওয়ানবাজার সিএ ভবন অডিটোরিয়ামে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘মনিটরি পলিসি অ্যান্ড ইমপ্লিকেশন’ বিষয়ক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

আতিউর রহমান বলেন, অনেকদিন ধরে বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। প্রতিবারই মুদ্রানীতিতে বিশ্ব অর্থনীতির একটি পর্যালোচনা থাকে। মূল্যস্ফীতি শেষ পর্যন্ত মুদ্রাজনীত বিষয়। এই সংকটের সময় ডলার সরবরাহ আরও বাড়ানো দরকার। তাহলে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হবে।

ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডে আমরা সবাই যদি আরও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারতাম, তাহলে সুদের হার বাজারভিত্তিক করা সম্ভব হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিৎ বন্ড ও ট্রেজারি বিলের মার্কেটিং আরও ডিজিটাল করা। পাশাপাশি পুঁজিবাজারে যেরকম প্রতিদিন কেনাকাটা হয় সেরকমভাবে বন্ড ও ট্রেজারি বিলের লেনদেনের সুযোগ দেওয়া উচিৎ।

তিনি বলেন, মুদ্রানীতি চেষ্টা করেছে ফিসকাল পলিসির সঙ্গে মিল রেখে পলিসি দেবার। এবছর মনিটর পলিসির আলোচনায় প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলতে চাই না। নতুন মুদ্রানীতির বড় লক্ষ্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। এর অন্যতম লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতি বাগে আনা। আমি মনে করি, মনিটরিং পলিসিতে যেসব ফ্রেমওয়ার্ক ও পলিসি নেওয়া হয়ছে তাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সাবেক এই গভর্নর বলেন, মনিটরি পলিসিতে অভ্যান্তরীণ ও বেসরকারি খাতের ঋণ কিছুটা কমানোসহ সরকারি ঋণ ৩ শতাংশের মতো বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যদিও সরকারের ঋণ বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত হয়তো এটি বাস্তবায়ন হবে না। কারণ নির্বাচনের বছর দুই ধরনের প্রবণতা থাকে। একটি হলো জনগনের জন্য অনেক বেশি খরচ করা হয় এবং অন্যটি নির্বাচনের আগে তিন চার মাস বড় কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় না। বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত এক বছর ধরে পলিসি রেট বাড়িয়েছে। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক এখনো থামার মতো কোনো লক্ষন নেই। পার্শবর্তী দুই দেশ ভারত ও থাইল্যান্ডও একই উপায়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনেছে। এক্ষেত্রে ভারতে মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

এতে মডারেটর হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইসিএবির সাবেক সভাপতি ও কাউন্সিল সদস্য মো. হুমায়ুন কবির।

এছাড়া প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মাহবুব আহমেদ, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, জেবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে এফবিসিসিআইর উপদেষ্টা আবদুল হক, দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন প্রধান শওকত হোসেন মাসুম, আইসিএবির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডাঃ জামালউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এবং বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান।

বিটিএমএ প্রেসিডেন্ট বলেন, দেশে খেলাপি ঋণ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। তবে বেনামি ঋণ কতো তা নিয়ে কেউ লেখে না। বেনামি ঋণের বোঝা ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত বছর দেশে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি আমদানি করা হয়েছিলো। তবে চলতি বছর লাগবে ১০ বিলিয়ন ডলার। আমদানি নির্ভর জ্বালানি দিয়ে এদেশের ইন্ডাস্ট্রি খাতের উন্নয়ন হবে না। রাষ্ট্রের বোঝা ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। শিল্প খাতের ওপর অনেক চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিছু লোক বিদ্যুৎ খাতে ব্যবসা করে রাতারাতি বিলিয়নার হয়ে গেছে। এসব লোকদের হাতে দেশ ছেড়ে দিলে যতই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন, তাতে কোনো লাভ হবে না।

তিনি আরও বলেন, দেশে হোল্ডিং ট্যাক্স দিচ্ছে ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। আর ট্যাক্স দিচ্ছে মাত্র ৩০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশ সরকার যদি শিল্প বন্ড ছাড়তো, সেই অর্থ শিল্পে বিনিয়োগ করতে পারতো। কোনো ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নেই। তারা অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। তবে আগামী দিনের মুদ্রানীতিতে শিল্পে বিনিয়োগের জন্য ভালো চিত্র থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

আলোচনায় আইসিএবি সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন সংকটের মধ্যেই মুদ্রনীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন এই মুদ্রানীতিতে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার মূল চ্যালেঞ্জ হল অর্থ সরবরাহকে কঠোর করে মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। গত দুই বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ ভূ-রাজনৈতিক সংকটের কারণে বর্তমান বিশ্ব একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। করোনা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। পণ্যের বাজার ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি হবে ৮ দশমিক ৬ শতাংশের কাছাকাছি।

তিনি বলেন, সংকটের এমন পরিস্থিতিতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোজোন এবং ভারতের মতো অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথ অনুসরণ করেছে। টাকার বিপরীতে ক্রমবর্ধমান ডলারের মূল্য, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবণতা এবং বর্তমান বাজার পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে।

হুমায়ুন কবির বলেন, এবারের মুদ্রানীতিতে তিনটি বিষয় গুরুত্ব দে্ওয়া হয়েছে। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের বিনিময় হারের চাপ নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ ও খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

অর্থসূচক/এমএইচ/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.