‘আমদানি কমিয়ে রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাবে না’

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে। রেকর্ড সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি হলেও প্রবাসী আয় বাড়ছে না, উল্টো কমছে। পাশাপাশি রফতানি আয়ে চলছে নিম্নমুখী ধারা। এসবের প্রভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে আমদানি কমিয়েও ডলার সংকট কাটানো সম্ভব হচ্ছে না। অর্থসূচককে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাতকারে অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতির কারণ আর উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অর্থসূচকের নিজস্ব প্রতিবেদক মো. সুলাইমানমাসুম রহমান

অর্থসূচক: দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি কোন দিকে যাচ্ছে? অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। আপনি বিষয়য়গুলোকে কীভাবে দেখছেন?

ড. আহসান মনসুর: বর্তমানে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে সংকট সেটা শুরু হয়েছে, গত ১৫ থেকে ১৮ মাস আগে। এটাকে আমরা এখনো স্থিতিশীল করতে পারি নি। এর ফলে দেশে মূল্যস্ফীতি অনেকদিন ধরেই উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। আমাদের টাকার মূল্যমান নিয়ে বেশ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কার্ভ মার্কেটের সঙ্গে ইন্টারব্যাংক মার্কেটে ডলার-টাকার বিনিময় হারে বড় পার্থক্য বিরাজ করছে। এর সাথে যোগ হয়েছে ব্যাংকিংয়ের কিছু সমস্যা। ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট চলছে। আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমে  অর্ধেে নেমেছে।  গত ২০-৩০ বছরে আমানতের এত কম প্রবৃদ্ধি হয়নি। আস্থাহীনতা বা যে কারণেই হোক ব্যাংকিং খাতে আমানতকারীরা উধাও হয়ে গেলো। এতে এই অস্থিরতাগুলো তৈরি হয়েছে।

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি কমিয়ে রিজার্ভ পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে। আমদানি কমায় বাণিজ্য ঘাটতিও কিছুটা কমেছে। কমেছে চলতি হিসাবের ঘাটতিও। কিন্তু তাতেও ডলার সংকট ও রিজার্ভের পতন কমেনি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমদানি কমিয়ে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবো কি-না? এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে যে, বিদেশ থেকে যে স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগ আসে তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত ব্যবসায়ীরা স্বল্পমেয়াদী এসব ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে থাকে। এগুলো শুধু বন্ধই হয়নি, আগে যেগুলো দেওয়া হয়েছিলো সেগুলো তারা ফেরত নিচ্ছে। ফলে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক হয়ে গেছে। এটি গত বছর ১৩ দশমিক ৭ বিলয়ন ইতিবাচক ছিলো। ২০২১ সালে ছিল ১৪ বিলিয়ন সহ আগের ২০ বছর ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ইতিবাচক ছিলো। এই প্রথম ঋণাত্মক হয়েছে। বর্তমানে এর পরিমাণ ২২৫ (ঋণাত্মক) কোটি ডলার। এরফলে দেশের ক্ষতি হয়েছে ১৬০ কোটি ডলার। এই ক্ষতি আমরা কাটাতে পারছি না। ফাইন্যান্সিয়াল একাউন্ট যদি ঋণাত্মক না হতো তাহলে রিজার্ভে এতো পতন হতো না। তাহলে আমরা নিজেরাই অর্থায়ন করতে পারতাম। সবমিলিয়ে আমরা ক্ষতির মধ্যেই রয়েছি। এরফলে রিজার্ভে বড় ধরনের পতন হচ্ছে। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টকে কিভাবে ইতিবাচক করা যায় এজন্য চেষ্টা করতে হবে। শুধু আমদানি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি কমিয়ে দেশের প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখা সম্ভব আছে।

অর্থসূচক: দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমেই কমছে। অর্থনীতিবিদসহ অনেকেই এটিকে উদ্বেগের বিষয় মনে করছেন। অন্যদিকে সরকার দাবি করছে, রিজার্ভ পর্যাপ্ত আছে। আসলেই কী রিজার্ভ নিয়ে অস্বস্তির কোনো কারণ নেই?

আহসান এইচ মনসুর: রিজার্ভের বর্তমান যে অবস্থা তাতে অবশ্যই উদ্বেগের কারণ আছে। উদ্বেগের কারণ না থাকলে আমরা আইএমএফের কাছে যেতাম না। প্রথমত আমি রিজার্ভের দুটো সূচকের দিকে তাকাতে বলবো। একটা হচ্ছে রিজার্ভের পরিমাণ। আর অন্যটি হচ্ছে গতিধারা। রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা কম থাকলেও ধারাটি উর্ধ্বমুখী থাকলে বিষয়টি স্বস্তির। আর ধারাটি নিম্নমুখী হলে তা অবশ্যই উদ্বেগের।

আমাদের রিজার্ভ পতন যখন শুরু হয়, তখন লেভেলটা উঁচুতে ছিলো। শুরুর দিকে তাই একটু অস্বস্তি থাকলেও চিন্তার কারণ ছিলো না। কিন্তু গত ১৫ মাসে আমাদের রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। এটি ৪৮ বিলয়ন ডলার থেকে  ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর আইএমএফের হিসাবে ধরলে এটা হয় ২৩ বিলিয়ন ডলার। প্রশ্ন হলো রিজার্ভের এই পরিমাণ কি যথেষ্ট? এই রিজার্ভ দিয়ে তিন বা সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বর্তমান রিজার্ভ যদি স্থির থাকতো বা এর গতি হতো উর্ধমুখী তাহলে উদ্বেগের কিছু থাকতো না।

রিজার্ভ নিয়ে অস্বস্তির কারণটি হচ্ছে, এর ধারাটি নিম্নমুখী। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যে তিন মাসের নিচে নেমে আসবে না তার নিশ্চয়তা নেই। রিজার্ভ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সরকারের নীতিগত পরিবর্তন আমরা দেখছি না। বাংলাদেশ ব্যাংক এক্সচেঞ্জ ডলারের দাম ১০৫ বা ১০৭ টাকায় নির্ধারণ করেছে। এটি ফিক্সড হওয়াতে আমাদের রিজার্ভে পতন হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি বলতো আমি ডলার বিক্রি করবো না। এক্সচেঞ্জ রেট যেখানে ইচ্ছে যাক, আমরা হস্তক্ষেপ করবো না। তাহলে কিন্তু রিজার্ভের পতন হতো না। অনেকদিন ধরেই আমরা নির্ধারিত এক্সচেঞ্জ রেটে আছি, বাজারের সঙ্গে যার কোনো মিল নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারভিত্তিক করতে পারলে রিজার্ভের এই অবস্থা হতো না।

অর্থসূচক: রপ্তানি আয়েও নিম্নমুখী ধারা দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কী বলে মনে করেন? আর উত্তরণেরই-বা কী উপায়?

আহসান এইচ মনসুর: উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ইউরোপ ও আমেরিকায় চাহিদার বড় পতন হয়েছে। কমে গেছে পণ্য বিক্রি। তাদের অনেক অবিক্রিত পণ্য রয়ে গেছে। এ কারণে নতুন ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে আমাদের রপ্তানিও কমেছে। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি যথটা খারাপ হয়েছে, আমাদের রপ্তানি কিন্তু ততটা খারাপ করেনি। এ সময়ে কিন্তু চীন ও ভিয়েতনামের রপ্তানি কমেছে আমাদের চেয়ে অধিক হারে।

অর্থসূচক: গত বছর বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। এখনো রপ্তানির ধারা উর্ধমুখী। কিন্তু এর পরও আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ছে না কেন?

আহসান এইচ মনসুর: গত বছর প্রায় ১১ লাখ বাংলাদেশী বিদেশে গিয়েছে। এবছরও ইতিমধ্যে ৮ থেকে ৯ লাখ চলে গেছে। মানুষ যেসব দেশে যাচ্ছে সেসব দেশের অর্থনীতিও চাঙা। সৌদি আরব তাদের তেলের জন্য খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। দুবাই, কাতার ও মালয়েশিয়াও ভালো অবস্থানে রয়েছে। মালয়েশিয়া জ্বালানি তেলের পাশাপাশি ভোজ্যতেলও রপ্তানি করে। সবমিলিয়ে আমাদের ট্রেডিশনাল মার্কেটগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবস্থা ভালো। দেশগুলোর অর্থনীতি ভালো হওয়ায় শ্রমিকরাও ভাল বেতন পাচ্ছে। কিন্তু এসব ইতবাচক দিক সত্ত্বেও টাকা আসার পরিমাণ কমে গেছে। অর্থ পাচার ও হুন্ডির বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে।

সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে। তারা খুব সহযেই ওখানকার মুদ্রা ডলারে কনভার্ট করে যে কোন দেশে পাঠিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই টাকা সরাচ্ছে। হুন্ডির টাকা দেশ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে শ্রমিকদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। আর ডলার যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশে চলে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের মাটিও স্পর্শ করছে না। এর ফলে হুন্ডি ব্যবসায় ঠেকানো খুব কঠিন। এর মূল কারণ হচ্ছে আমাদের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা। আমাদের দেশে অবৈধভাবে ব্যাপক সম্পদ অর্জিত হচ্ছে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ অবৈধভাবে চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অবৈধ অর্থের জন্য রাজনৈতিক কৌশলের কথা বলি আর ব্যবসায় গ্রুপের কথাই বলি, তারা কিন্তু প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক। এসব ব্যক্তিরা এখান থেকে অর্থ সরিয়ে ফেলছে। যেহেতু নির্বাচনের বছর অনেককিছুই হয়ে যেতে পারে, এমন ভয় ও শঙ্কা থাকে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলে লোকেরা অর্থ সরিয়ে ফেলে।

অর্থসূচক: বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সংকট কাটাতে আমদানি কমিয়েছে। এতে কি সংকট কাটবে?

আহসান এইচ মনসুর: শুধু আমদানি কমিয়ে আমরা এই সংকট থেকে হয়তো উত্তরণ পাবো না। ইতিমধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ৫৪ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ৩৩ শতাংশ কমেছে। এভাবে যদি কমতে থাকে তাহলে উৎপাদন কমবে। মূলধনী যন্ত্রপাতি কমে গেলে ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। সব মিলিয়ে অবস্থাটা ভালো নেই। চলতি হিসাবে অনেক সমন্বয় করা হয়েছে। এখন ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট এবং ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি কমাতে হবে। সরকার ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে বিদেশি বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে অর্থ নিয়ে আসে। এটার পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। আর ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে প্রবাহ বাড়াতে হবে। এটি করতে পারলে বাণিজ্য ঘাটতি আমরা একটি ভারসাম্য অবস্থানে নিয়ে আসতো পারবো। তখন রিজার্ভ বাড়তে থাকবে। তবে সেটা করার মতো পরিস্থিতি এখন নেই। কারণ এর জন্য সুদের হার ও এক্সচেঞ্জ রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু সেই ধরনের নীতি বাস্তবায়ন করার মতো মানসিকতা সরকারের আছে কিনা সেটা দেখার বিষয়।

অর্থসূচক: কিছুদিন পরেই বড় আকারের কিছু বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। এছাড়া বেসরকারি খাতে নেওয়া বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপও আছে। এমন পরিস্থিতিতে রিজার্ভকে সন্তুুষজনক পর্যায়ে ধরে রাখার উপায় কী?

আহসান এইচ মনসুর: রিজার্ভ ধরে রাখতে হলে সরকারকে খুব শক্ত নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। মূল্যস্ফীতি ৯ বা ১০ শতাংশে রাখা যাবে না, এটি যেভাবে হোক কমাতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতি যদি বেশি হয় তাহলে টাকার মান কমে যাচ্ছে। ডলারের মূল্যস্ফীতি যতি ৩ শতাংশ হয় এবং টাকার মান যদি ১০ শতাংশ হয় তাহলে টাকার মান ৭ শতাংশ বেশি কমলো। সেটি খুব ভালোভাবে আমলে নিতে হবে। দ্বিতীয়ত টাকাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য সুদের হার ছেড়ে দিতে হবে। টাকার লাভ যদি ভালো পরিমাণ না দেওয়া হয় তাহলে টাকা কেন মানুষ ধরে রাখবে। একদিকে মূল্যস্ফীতি অন্যদিকে যদি সুদের হার কম হয় তাহলেতো মানুষ টাকা রাখবে না। তাই বেশিরভাগ লোক টাকা নিয়ে জমি ও বাড়ি কিনছে। এরফলে ব্যাংকের আমানত কমে যাচ্ছে। এই অবস্থাটা অর্থনীতির জন্য খুবই খারাপ। এর ফলে অর্থের বিনিয়োগ হচ্ছে না। এজন্যই টাকার ভালো লাভ দিতে হবে। তাহলেই মানুষ টাকা ধরে রাখবে।

অর্থসূচক: সম্প্রতি তিন দেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানকার ব্যবসায়ীদের প্রতি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে বিনিয়োগ পরিবেশে কী ধরনের পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করেন?

আহসান এইচ মনসুর: বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিস্থিতি কখনোই ভালো ছিলো না। বিশ্ব ব্যাংক যখন রিপোর্ট প্রকাশ করতো তখন দেখা যেত, ১৭৫ বা ১৭৬ তম স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো। যেখানে মোট দেশ থাকতো ১৮০টি। এখনো একইরকম অবস্থার মধ্যে হয়তো আছে। করোনা ও যুদ্ধের মধ্যেও আমরা বড় কোন পরিবর্তন দেখিনি। আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রত্যাক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না। গত বছর এফডিআই কিছুটা বেড়েছে। যা এখনো তিন বিলিয়ন ডলারে। গত বছর বিদেশি কোম্পানিগুলো লাভের অংশ পুনরায় বিনিয়োগ করেছিলো। এর ফলে তখন প্রত্যাক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছিলো। নতুন করে কেউ টাকা নিয়ে আসেনি। গ্রীণ ফিল্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিমাণ কমেছে। এটার পরিবর্তন যে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে হবে সেটারও কোন লক্ষণ নেই। কারণ সরকার বড় ধরনের কোন সংশোধন করেনি।

অর্থসূচক: আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জাপান বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানো ও সম্পর্ক উন্নয়নে আগের চেয়েও আগ্রহী হয়ে উঠেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই আগ্রহকে আমরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারি?

আহসান এইচ মনসুর: এটি একটি নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে। জাপানে প্রধানমন্ত্রী যখন গেলেন তখন সেই দেশেরই প্রস্তাব ছিলো যে, বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ করে সেটা ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যে নিয়ে যাবে। এই প্রচেষ্টা ভালো তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এখানে বাংলাদেশ লাভবান হবে। এছাড়া জাপানের পাশাপাশি ভারতও লাভবান হবে। কারণ পূর্ব ভারতের এসব রাজ্যগুলো খুবই গরীব। এসব অঞ্চল আর্থিকভাবে লাভবান হবে এবং বড় বড় কিছু ব্যবসা যুক্ত হবে। বাংলাদেশ মাতারবাড়ি পোর্ট ব্যবহার করতে পারবে। আমরা চিটাগং এবং মোংলা বন্দর ইতিমধ্যে ব্যবহার করছি। আগামীতে এসব পোর্ট আরও বেশি ব্যবহার করতে পারবো এবং ক্লায়েন্ট হবে ইন্ডিয়ার এসব রাজ্যগুলো। এভাবে করলে সম্ভাবনা আরও ভালো হবে বলে আমি মনে করি।

অর্থসূচক: দেশের ব্যাংকিং খাতও বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

আহসান এইচ মনসুর: ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। দিন দিন মন্দ ঋণের অনুপাত বাড়ছে। খাতটিতে মন্দ ঋণের অনুপাত ইতিমধ্যে ১০ শতাংশে ঠেকেছে, এই পরিমাণ আরও বাড়বে। লোন রি-শিডিউলে এবং আদলতে যে টাকা আটকে আছে তা হিসাবে ধরলে ব্যাংক খাতের মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাড়াবে ২৩ থেকে ২৫ শতাংশে। এধরনের ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বড় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সমস্যাগুলোকে ঢেকে রাখা হয়েছে। ব্যাংক খাতের অনেক বড় সমস্যা এবং এটি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখানে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনের প্রয়োগ ঠিকমতো হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতের এই সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে হলে বড় ধরনের সংশোধন করতে হবে। এখানে বোর্ডের আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। এছাড়া ছোট ছোট ব্যাংকগুলোকে মার্জ করতে দিতে হবে। আমরা সম্প্রতি ব্যাংক মার্জ করার ঘণ্টা বিশ্বে দেখেছি। এছাড়া ব্যাংক খাতে যেসব কেলেঙ্কারীগুলো হচ্ছে তার বিচার করতে হবে। এসব ঘটনার বিচার করা হচ্ছে না। সরকারের দূর্বল সতর্কবার্তায় এসব সমস্যার সমাধান হবে না। এখানে কঠোর পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে এবং আইনগুলোকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। একইসঙ্গে দোষীদেরকে জেলে পাঠাতে হবে।

অর্থসূচক: উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য যুদ্ধই কী একমাত্র কারণ, না-কি আরও বিষয় জড়িত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রান্তিক মানুষের দুর্ভোগ কমাতে এই মুহুর্তে করণীয় কী?

আহসান এইচ মনসুর: বিশ্বব্যাপী সমস্যাগুলোর যুদ্ধ একটি কারণ, যেটা এখনও আছে। যুদ্ধের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম যা বেড়েছিলো সেটা আবার আগের অবস্থায় বা তার চেয়েও নিচে চলে এসেছে। চাল, গম ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছিলো তাও কমেছে। ডলারের দাম বিশ্বে আগের অবস্থার কাছাকাছি বা তার চেয়েও নিচে নেমেছে। গড়ে সবকিছুর দাম যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। ভারতের মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। সব দেশের মূল্যস্ফীতি কমলেও আমাদের কমছে না। কারণ আমরা মূল্যস্ফীতি কমানোর কোন উদ্যোগ নেইনি। সবাই সুদের হার বাড়ালেও আমরা কিন্ত বাড়াইনি। ভারতে আগামী দুই মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৩ শতাংশে নেমে আসবে। কিন্ত আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি কমেছে না এটা আমাদের দূর্বলতা। বহির্বিশ্বের ঘটনা দিয়ে হয়তো বিভিন্ন সমস্যা শুরু হতে পারে, তবে বর্তমানে সেই সমস্যাগুলো নেই। বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা সেটা আমাদের নীতিগত কারণে তৈরি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হয়তো আরও ৫ বছর চলতে পারে। যুদ্ধ চললেও বিশ্ব বসে নেই। তারা নতুন অর্থনীতি খুজে নিয়েছে। সুতরাং আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। ইউক্রেন ও রাশিয়াকে দোষারোপ করে আমরা পার পাবো না।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.