‘অর্থনৈতিক সাংবাদিকতায় চ্যালেঞ্জ বাড়ছে’

আজ ৪ মার্চ ত্রিশ বছরে পা রেখেছে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের অনন্য প্ল্যাটফরম ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)। এই দীর্ঘ পথযাত্রায় অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার মান উন্নয়নে অসাধারণ অবদান রেখেছে এই সংগঠন। তিন দশক আগে ১৯৯৩ সালে যে ক’জন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাংবাদিকের হাত ধরে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়, তাদের একজন শামসুল হক জাহিদ। তিনি ছিলেন ইআরএফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক। অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃত শামসুল হক জাহিদ বর্তমানে ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। ইআরএফের প্রতিষ্ঠা দিবসে অর্থসূচককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে ইআরএফ ও অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার নানা দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন তিনি।

সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন অর্থসূচক সম্পাদক জিয়াউর রহমান ও স্টাফ রিপোর্টার সুলাইমান।

অর্থসূচক: আজ ৪ মার্চ ইআরএফ প্রতিষ্ঠা দিবস। এ দিবসে আপনিসহ প্রতিষ্ঠাকালীন সব সদস্যকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। আজ এই বিশেষ দিনে ইআরএফ প্রতিষ্ঠার গল্পগুলো যদি একটু বলতেন।

শামসুল হক জাহিদ: আমরা যখন অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন কিন্তু এর পরিসর আজকের মতো এত বড় ছিল না। আমরা অল্প কয়েকজন রিপোর্টার অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করতাম। বর্তমানে অর্থনীতির মধ্যেই অনেকগুলো বিট। অনেক রিপোর্টারকে শুধু একটি বা দুটি বিটের নিউজ করলেই হয়। তখন কিন্তু একজন রিপোর্টারকেই অর্থনীতির সব ধরনের নিউজ করতে হতো। তাই বিভিন্ন বিষয়ে নিউজ করতে গিয়ে উপলব্ধি হয়, এসব বিষয়ে আমাদের জানাশোনার কিছু ঘাটতি আছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু প্রশিক্ষণের আয়োজন করা গেলে নিউজের মান আরও ভাল করা সম্ভব। অন্যদিকে পত্রিকার সম্পাদক এবং গেটকিপারদের দৃষ্টিভঙ্গীজনিত কিছু সমস্যাও ছিল তখন। আমরা অর্থনীতির যত ভাল নিউজই দিইনা কেন, সেগুলো প্রাপ্য ট্রিটমেন্ট পায় না। নিউজের জায়গা হয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় পৃষ্ঠায়। বড়জোড় পেছনের পাতায়। তা-ও দুই কলামের বেশি ট্রিটমেন্ট পাওয়া যায় না।

এমন পরিস্থিতিতে একদিন আমাদের সহকর্মী দৈনিক জনতার তৎকালীন অর্থনৈতিক রিপোর্টার শহীদুজ্জামান আমাকে এসে বলেন, আমরা যারা অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা করি, তাদের একটি প্ল্যাটফরম করলে কেমন হয়? আমি তখন বাংলাদেশ টাইমসের চিফ রিপোর্টার। আমি বললাম, এটা খুবই ভাল একটি প্রস্তাব। তখন আমি আরও কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করি। এর প্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালের ৪ মার্চ সিদ্ধেশ্বরীতে দৈনিক জনতার তৎকালীন কার্যালয়ে একটি সভা করি। ওই সভায় আমাকে আহ্বায়ক এবং শহীদুজ্জামানকে যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই কমিটি ইআরএফ গঠনের বাকী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।

অর্থসূচক: ইআরএফ গঠনের বিষয়ে অন্যদের কাছ থেকে আপনারা কেমন সাড়া পেয়েছিলেন এবং শুরুর দিকে কতজন সদস্য ছিলো?

শামসুল হক জাহিদ: আমরা সবার কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। তৎকালীন অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সবাই এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ শুধু দক্ষতা উন্নয়নের বিষয় নয়, অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের কিছুটা সুরক্ষা দেওয়ার জন্যেও একটি প্ল্যাটফরম জরুরি হয়ে উঠছিল। কারণ অনেক সময় কোনো রিপোর্ট স্বার্থান্বেষী মহল বা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে গেলে তারা নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করার চেষ্টা করতো। ঋণ খেলাপী নিয়ে একটি রিপোর্ট করতে গিয়ে আমিও এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখী হয়েছিলাম।

আজকে ব্যাংকের ডিফল্ট কালচার নিয়ে আমরা অনেক রিপোর্ট করছি, সবাই অনেক সোচ্চার। এর শুরুটা কিন্তু হয়েছিল ১৯৮২/৮৩ সালের দিকে। আমি বাংলাদেশ টাইমসে কাজ করি। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ নিয়ে আমি একটি রিপোর্ট করি। সম্ভবত খেলাপি ঋণ নিয়ে সেটি ছিল প্রথম ব্রেকিং নিউজ। ওই সময়ে তৎকালীন শিল্প ঋণ সংস্থা (বিআরএস) এবং শিল্প ব্যাংক শিল্প খাতে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ দিতো। এসব ঋণের একটি বড় অংশ খেলাপি হয়ে পড়েছিল। মহিউদ্দিন খান আলমগীর এমপি তখন ছিলেন শিল্প ব্যাংকের। আমার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিলো। সে আমাকে একদিন একটা তালিকা ধরিয়ে দিলো। তিনি বললেন, জাহিদ এটা একটু দেখেন। তারা অনেক ক্ষমতাবান, তাই টাকা পয়সা আদায় করতে পারছি না। সব কাগজপত্র মিলিয়ে আমি একটা রিপোর্ট করলাম। এটা সম্ভবত এরশাদ সাহেবের সামরিক শাসনের পর পর। এই নিউজ বের হওয়ার পরে এক মহা ঝামেলা তৈরি হলো। একে তো আর্মির সময়;  আর ওই খেলাপিরা ছিলেন প্রভাবশালী। আমার রিপোর্ট যেন ভিমরুলের চাকে ঢিল মেরেছে। তখন আমাদের সম্পাদক ছিলেন মোফাজ্জল ভাই। তিনি ছিলেন উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের বেশ পরিচিত। উপায় না দেখে তিনি তার শরনাপন্ন হলেন। এভাবে বিষয়টি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়।

আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন, ইউএনবির তৎকালীন রিপোর্টার শাকিল আনোয়ার, ডেইলি স্টারের ইনাম আহমেদ, ভোরের কাগজের সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, ইত্তেফাকের জাহিদুজ্জামান ফারুক ও আজকের কাগজের আসাদুজ্জামান। এই উদ্যোগে আরও অনেকে জড়িত ছিলেন।

অর্থসূচক: অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকতার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে তিন দশক আগে থেকে আপনারা সচেষ্ট ছিলেন। এত বছরে এই সাংবাদিকতা কতটুকু এগিয়েছে বলে মনে করেন আপনি?

শামসুল হক জাহিদ: অবশ্যই অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা অনেক দূর এগিয়েছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে এক্সেস টু ইনফরমেশন অনেক বেড়েছে। ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ইত্যাদির কারণে রিপোর্টারদের সক্ষমতা বেড়েছে। অন্যদিকে গণমাধ্যমের মালিক ও সম্পাদকদের দৃষ্টিভঙ্গীতেও এসেছে বড় রকমের পরিবর্তন। তারা অর্থনৈতিক রিপোর্টের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন। একটা সময় ছিল পলিটিক্যাল নিউজ গণমাধ্যমকে ডমিনেট করত। এখন অর্থনৈতিক নিউজ অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নিউজের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। শুধু তাই নয়, বর্তমানে অর্থনীতি বিষয়ক একাধিক দৈনিক পত্রিকা সাফল্যের সাথে পরিচালিত হচ্ছে। এটি কিন্তু অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার অগ্রগতির অন্যতম বহিঃপ্রকাশ।

অর্থসূচক: অনেকেই অভিযোগ করেন, করপোরেটদের ক্রমবর্ধমান চাপ ও প্রভাব অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

শামসুল হক জাহিদ: এটা কোনো ক্ষেত্রে সত্যি; আবার কোনো ক্ষেত্রে সত্যি না। এটা অনেকটা মালিকের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। অনেক নিজেদের ব্যবসাকে সুরক্ষা দেওয়া, প্রতিপত্তি বাড়ানো ও কানেকশন তৈরির জন্য পত্রিকা প্রকাশ করছেন। আবার অনেক সংবাপত্র প্রকাশের পেছনে রয়েছে একান্তই পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গী।  আবার রাষ্ট্রের দায়িত্ব, স্বচ্ছতা এবং পরিবেশ সাংবাদিকতার উপর একটা বিরাট প্রভাব ফেলে। যখন রাজনীতি সহ সব কিছু ফ্রী থাকে অর্থাৎ জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা থাকে তখন এই কাগজেও তার প্রতিফলন ঘটে। আমার রিপোর্টেও সেটি প্রতিফলিত হবে। যখন আমি স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতার পক্ষে থাকবো তখন আমার পেছেন এসে সবাই দাড়াবে। এখন সেই জিনিসটাতে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে।

ইআরএফ প্রতিষ্ঠার তিন দশক উপলক্ষ্যে নিজস্ব কার্যালয়ে কেক কাটছেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক শামসুল হক জাহিদ। পাশে সংগঠনের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মৃধা, সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম, প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমানসহ অন্যরা

 

অর্থসূচক: অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আর কি কি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন আপনি? এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের কী ধরনের প্রস্ততি নেওয়া প্রয়োজন?

শামসুল হক জাহিদ: চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তো আমি ইতিমধ্যে বলেছি। মালিকের পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ হতে পারে, সরকারের পক্ষ থেকে হতে পারে, নিজস্ব চ্যালেঞ্জও থাকতে পারে।  সবকিছু যখন সুন্দর ও সামাজিক হবে তখন এমনিতেই আমরা উন্নতি লাভ করতে পারবো। অর্থনীতি ও গনতান্ত্রিক অবস্থার উন্নতি লাভ করলে এর প্রভাব কাগজের উপর পড়বে। আমাদের অর্থনৈতি অবস্থার অনেক উন্নতি হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের গ্রোথ আছে তবে যে পরিমাণ হওয়ার কথা ছিলো তা হয় নি। আমাদের ব্যবস্থাপনপায় কিছু সমস্যা থাকতে পারে। তবে আমাদের দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও করোনা ও যুদ্ধের কারণে আমরা কিছুটা পিছনে পড়েছি। যদি খোলা পরিবেশে কিছু থাকে তাহলে সেটা আগাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন আমরা যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি যদি নিশ্চিত করতে পারি তাহলে আমরা আরো এগিয়ে যাবো।

অর্থসূচক: প্রতিষ্ঠার তিন দশকে পা রেখেছে ইআরএফ। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?

শামসুল হক জাহিদ: স্বাভাবিকভাবে আমাদের সবকিছুইতো বাড়বে। ইআরএফের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে। এটি ছিলো আমার পকেট সংগঠন। যখন শুরু করি তখন প্রেসক্লাবে একটি লকার ছিলো। লকারে এ সংগঠনটির খাতাপত্র থাকতো আর আমি চালাতাম। প্রতি মাসে একটি ওয়ার্কশপ বা ইভেন্ট করতাম। নিজেই আমি বেকারি থেকে পেটিস কিনে আনাতাম। নিজের অফিসের পিওন পাঠিয়ে একটি ব্যানার বানিয়ে আনতাম। এছাড়া প্রেস ক্লাবের লকারের খরচ দিতাম না। প্রেস ক্লাবের তখন প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি ভাড়া নিতে চাইতো না। এরপর এশিয়া ফাউন্ডেশন থেকে একটা সাপোর্ট পেলাম। তারপর খুব হিসেব নিকেশ করে আমি ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রায় দেড় বা দুই লাখ টাকা রেখে আসছি। এটাতো বিরাট পরিক্রমা, আজকে সংগঠন বড় অফিস করেছে এবং অনেক সদস্য।

অর্থসূচক: অর্থনীতি সাংবাদিকতার মান উন্নয়নে আর কী কী উদ্যোগ নিতে পারে ইআরএফ?

শামসুল হক জাহিদ: ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি বাড়ানোর প্রতি অনেক মনোযগ দিতে হবে।  অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা আগে বুঝতে হবে। ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি যত বাড়বে, তত ভাল হবে রিপোর্টের মান। প্রতিবেদনের মান বাড়ানো এবং সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়নে সব ধরনের পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে হবে।

অর্থসূচক: ইআরএফের বর্তমান কমিটি ও আগামী নেতৃত্বের প্রতি আপনার বিশেষ কোনো পরামর্শ থাকলে একটু বলবেন প্লিজ।

শামসুল হক জাহিদ: অবশ্যই সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ-কর্মশালা ইত্যাদিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। সাংবাদিকতা ও অর্থনীতিতে যে নতুন নতুন বাঁক বদল হচ্ছে, সদস্যরা যাতে সেসব পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে সে লক্ষ্যে উপযোগী প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। ইআরএফ অবশ্যই নানা বিনোদনমূলক কর্মসূচির আয়োজন করবে; তবে তা যেন প্রধান যে উদ্দেশ্য-সদস্যদের দক্ষতার উন্নয়ন তাকে ছাপিয়ে না যায়।  বিনোদন করতে গিয়ে ইআরএফকে যেন ক্লাবে পরিণত না করি। সদস্যরা যাতে বস্তুগত প্রাপ্তির চেয়ে পেশাগত মানের উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দেন, সেই সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে হবে। আর অবশ্যই নতুন সদস্য পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। সদস্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। ভোটের বিবেচনা মাথায় রেখে সদস্য পদ না দেওয়াই শ্রেয়।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.