মেসির পেনাল্টি মিসের পরেও শেষ ১৬তে আর্জেন্টিনা

ফুটবল কখনো সুন্দর, কখনো নিষ্ঠুর। যে আর্জেন্টিনাকে মনে হচ্ছিল ছিটকে যাবে প্রথম রাউন্ড থেকেই, সব আশঙ্কা গুঁড়িয়ে দিয়ে পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়ে তারাই গ্রুপ ‘সি’র চ্যাম্পিয়ন।

অন্যদিকে যে পোল্যান্ডকে মনে করা হচ্ছিল সম্ভাব্য গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন, তাদেরই প্রায় বাদ পড়ার দশা! মেক্সিকোর বিপক্ষে সৌদি আরব শেষ সময়ে গোল না করলে যে পোল্যান্ডের বিদায় ঘন্টাই বেজে যেতো! বুধবার রাতে, স্টেডিয়াম ৯৭৪ এবং লুসাইল, দুই প্রান্তেই ভাগ্যের রংবদল হয়েছে মুহূর্তে মুহূর্তে। রেফারির লম্বা শেষ বাঁশি যখন বেজেছে দুই প্রান্তেই, তখনই স্পষ্ট হচ্ছে কোন দুই দল যাচ্ছে শেষ ষোলোয়। ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই নকআউটে পা রাখলো আর্জেন্টিনা, যেখানে তাদের অপেক্ষায় অস্ট্রেলিয়া। পোল্যান্ড আর মেক্সিকোর পয়েন্ট সমান হলেও গোলগড়ে পিছিয়ে বাদ পড়েছে মেক্সিকো।

পোল্যান্ডের সঙ্গে হারলেই বিদায় আর জিতলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন- এমন বিপ্রতীপ সমীকরণের সামনেই দাঁড়িয়েছিল আর্জেন্টিনা। মেক্সিকোর বিপক্ষে ২-০ গোলে জয়ের ম্যাচে শুরুর একাদশে লিওনেল স্ক্যালোনি আনেন দুটো পরিবর্তন। গোলদাতা এনজো ফার্নান্দেস শুরু থেকেই খেলেন গুইদো রদ্রিগেসের জায়গায় আর ফরোয়ার্ড লাউতারো মার্তিনেজের বদলে জুলিয়ান আলভারেজ। লিসান্দ্রো মার্তিনেজের জায়গা হয়নি একাদশে, এসেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোমেরো।

জয়ের জন্য মরিয়া আর্জেন্টিনা শুরু থেকেই ঝাঁপায় গোলের জন্য। অন্যদিকে অতি রক্ষণাত্মক কৌশলে পোল্যান্ড নিজেদের ডি-বক্সে ডিফেন্ডারদের সংখ্যা বাড়িয়ে সাজায় দেয়াল। আর গোলবারের সামনে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ওয়েচিচ শেজনি। প্রথমার্ধে একের পর এক আক্রমণ করেও পোলিশ দূর্গে ফাটল ধরাতে পারেনি আর্জেন্টিনা।

বাম প্রান্তে মার্কোস আকুইনা উঠে আসেন বেশ কয়েকবার। লিওনেল মেসি বেশ কয়েকটা রক্ষণচেরা পাস বাড়িয়েছেন আকুইনার দিকে। কিন্তু কোনোটা ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন, কখনো বলের দখল পেলেও শট গেছে পোস্টের বাইরে দিয়ে। প্রথমার্ধের ৩০ মিনিটের পর অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াকে বাম প্রান্তে নিয়ে আসেন স্ক্যালোনি, তাতে আক্রমণে বাড়ে ধার। একের পর এক আক্রমণ প্রতিহত করে দিচ্ছিলেন শেজনি। অন্যদিকে পোল্যান্ডের প্রতি-আক্রমণভিত্তিক কৌশল মার খেয়ে যাচ্ছিল আর্জেন্টিনার হাই-লাইন প্রেসিংয়ের কাছে। মাঝমাঠেই পোলিশদের কাউন্টার অ্যাটাকের বিচ্ছিন্ন কিছু চেষ্টা আটকে দিচ্ছিলেন রদরিগো ডি পল।

ডি মারিয়া তো কর্নার কিকে গোল দিয়েই দিয়েছিলেন প্রায়, তার নেয়া কর্নার কিকটা রংধনুর মতো বেঁকে ঢুকে যাচ্ছিল জালে, যেটা শেষ মুহূর্তে কর্নারের বিনিময়ে বাঁচান শেজনি। সেই কর্নারটা নেন ডি পল, সেই কর্নার থেকেই সূচনা হওয়া আক্রমণে আলভারেজের শট বাঁচাতে শরীর লম্বা করে বাড়িয়েছিলেন শেজনি। তাতে হাত লাগে মেসির মাথায়, পড়ে যান মেসি। আর্জেন্টিনা দলের পক্ষ থেকে পেনাল্টির আবেদন করা হলে রেফারি ভিডিও রিপ্লে দেখে পেনাল্টির সংকেত দেন। স্পটকিকটা নিতে যান মেসি, তবে শেজনি বামদিকে ঝাঁপিয়ে সেই পেনাল্টি বাঁচিয়ে দেন।

অনেকগুলো সম্ভাবনা জাগিয়েও গোল করতে না পারার হতাশা আর মেসির পেনাল্টি মিসের আক্ষেপ নিয়েই বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয়ার্ধে খেলা শুরুর পর এক মিনিটের মাথায় ঘুচে যায় হতাশা, গোল করে দলকে এগিয়ে নেন অ্যালেক্সিস ম্যাকঅ্যালিস্টার। ডানপ্রান্ত থেকে নাহুয়েল মলিনার বাড়ানো আড়াআড়ি পাস বক্সের ভেতর খুঁজে নেয় অ্যালেক্সিস ম্যাকঅ্যালিস্টারকে। আনমার্কড ম্যাকঅ্যালিস্টার চলতি বলে ডানপায়ের শটে পাঠিয়ে দেন জালে। জাতীয় দলের হয়ে এটাই তার প্রথম গোল।

পোস্টে লেগে বল জালে জড়াতেই উল্লাসে মেতে ওঠে স্টেডিয়াম ৯৭৪ এর আর্জেন্টিনা সমর্থকরা।বিরতির পর একাদশে দুটো পরিবর্তন এনেছিলেন পোলিশ কোচ,মাইকেল স্কোরাস৷ জ্যাকন কামিনস্কি আসেন ক্যারল সিডেরস্কি আর ফ্র্যাঙ্কোউইস্কির জায়গায়। তারা নিজেদের জায়গা বুঝে দাঁড়াবার আগেই গোল খেয়ে বসে পোল্যান্ড। ম্যাচের ৬৭ মিনিটে, দ্বিতীয় গোলটা জুলিয়ান আলভারেজের। মেক্সিকোর বিপক্ষে এনজো ফার্নান্দেসের গোলের কার্বন কপিই বলা যায়। তবে এবার এনজোর অ্যাসিস্ট, বল নিয়ে কাটিয়ে বক্সের ভেতরে ঢোকার আগেই বক্সের ভেতর থাকা আলভারেজকে পাস দিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বলটা নিজের পায়ে নিয়ে ডানে একটু সরে জায়গা বানিয়ে জোরালো শট নেন আলভারেস, লক্ষ্য জালের ডানদিকের উপরের কোণ। সেদিকে জালে ঢুকে যায় বল, শেজনির করার ছিল না কিছুই।

৮৫ মিনিটে পোলিশ রক্ষণের ভুলে লাউতারো মার্তিনেজ একাই বল নিয়ে ঢুকে গিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের ডি বক্সে, কিন্তু সামনে একা গোলরক্ষককে পেয়েও বল জালে পাঠাতে পারেননি এই ফরোয়ার্ড। গোটা ম্যাচে মেসির ভূমিকা ছিল দারুণ উজ্জীবিত। আকুনাকে বেশ কয়েকটা সম্ভাবনাময় পাস বাড়িয়েছিলেন, মাঝমাঠ থেকে ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে মনে করিয়ে দেয়ার মতো দারুণ দুটো দৌড়ও ছিল। কিন্তু এই নিয়ে বিশ্বকাপে দুটো পেনাল্টিতে গোল করতে ব্যর্থ মেসি, ২০১৮ বিশ্বকাপে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে পারেননি গোল করতে স্পটকিকে আর পোল্যান্ডের বিপক্ষেও পারলেন না।

স্টেডিয়াম ৯৭৪-এ পোল্যান্ড যখন আর্জেন্টিনার কাছে ২-০ গোলে পিছিয়ে, ওদিকে মেক্সিকো সৌদি আরবের বিপক্ষে ততক্ষণে ২-০ গোলে এগিয়ে। পোল্যান্ড ও মেক্সিকো, দুই দলের পয়েন্ট সমান, গোল ব্যবধান সমান, শুধু ডিসিপ্লিনারি ইস্যুতে পোল্যান্ড এগিয়ে। এমন সময় গোল লাইন থেকে তেগলিয়াফিকোর শট বাঁচিয়ে দিয়েছেন কামিল জিলিক। কিন্তু ওদিকে সৌদি আরবের সালেম আলদাওসারি ইনজুরি সময়ে, ম্যাচের ৯৫ মিনিটে গোল করেন। তাতেই গোল ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে মেক্সিকো। ম্যাচের বাকি দুটো মিনিটে আর তারা পারেনি আরেকটা গোল করতে। তাই -১ গোল গড়ে পোল্যান্ডের পেছনে থেকে শেষ করলো মেক্সিকো, এখান থেকেই তাদের ধরতে হচ্ছে বাড়ির পথ।

ফেরা যাক আর্জেন্টিনা -পোল্যান্ড ম্যাচে। গোটা ম্যাচে পোলিশরা চেয়েছে রক্ষণ করেই কাটিয়ে দিতে, প্রথম ৪৫ মিনিটে এই কৌশলে সফলতা এলেও দ্বিতীয়ার্ধে ভেঙে যায় দেয়াল। এরপর অনেক সুযোগই পেয়েছে আর্জেন্টিনা, তাতে দুটো মাত্র গোল হওয়াতে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন মিশনিয়েকভিচ। কারণ, আর একটা গোল হজম করলেই মেক্সিকোর বদলে তাদেরকেই ধরতে হতো ফিরতি ফ্লাইট।

গোটা ম্যাচে মাত্র ২৫% বলের দখল ছিল পোলিশদের কাছে, আর্জেন্টিনার শট অন টার্গেট ১৩টি যার বিপরিতে পোল্যান্ডের ০! রবার্ট লেভানডোস্কির মতো একজন ফরোয়ার্ড থাকার পরও এই সংখ্যা জন্ম দেয় বিষ্ময়ের। পোল্যান্ড কর্নার পেয়েছে মাত্র ১টি, যেখানে আর্জেন্টিনা পেয়েছে ৯টি। এই অঙ্কের ফারাকইই বুঝিয়ে দেয়, কতটা কর্তৃত্ব নিয়ে খেলেছে আর্জেন্টিনা।

ওদিকে নিজেদের সাবেক উপনিবেশ টিউনিশিয়ার কাছে হেরে গেছে ফ্রান্স। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ বলেই তারকা খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দিয়ে ৯ পরিবর্তন এনে একাদশ সাজিয়েছিলেন দিদিয়ের দেশম। ডেনমার্কের বিপক্ষে ম্যাচের শুধু অরেলিয়ান চুয়ামেনি আর রাফায়েল ভারান। দেশম হয়ত ভেবেছিলেন বেঞ্চের শক্তিটা পরখ করে নেবেন, কিন্তু তাতে উলটো ফাঁদে পড়তে হয়েছে চ্যাম্পিয়নদের। ওয়াহবি খাজরির গোলে ফ্রান্সকে হারিয়ে দিয়েছে টিউনিশিয়া। ম্যাচের ইনজুরি সময়ে বদলি নামা আন্তোয়ান গ্রিয়েজমান গোল করে সমতা ফেরালেও ভিএআর গোলটি বাতিল করে দেয় অফসাইডের কারণে।

অন্য ম্যাচে বড় অঘটন অস্ট্রেলিয়ার, ৬০ মিনিটে করা ম্যাথু লেকির গোলে তারা হারিয়ে দিয়েছে অনেকের চোখেই ‘ডার্কহর্স’ ডেনমার্ককে। ফলে কোনো ম্যাচ না জিতেই বিদায় নিচ্ছে ইউরোর সেমিফাইনালিস্ট ডেনমার্ক। আর ২০০৬ সালের পর আবারও শেষ ষোলোতে অস্ট্রেলিয়া।

কাতারে বুধবার রাতে শেষ হয়ে গেল গ্রুপ ‘সি’ এবং গ্রুপ ‘ডি’ এর সব কয়টি ম্যাচ। ৪ ডিসেম্বর আহমদ বিন আলি স্টেডিয়ামে সি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ডি গ্রুপের রানার্স আপ অস্ট্রেলিয়া। একই দিনে ডি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স খেলবে সি গ্রুপের রানার্স আপ পোল্যান্ডের সঙ্গে। নকআউট পর্বের প্রথম ম্যাচটা ‘এ’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ‘বি’ গ্রুপের রানার্স আপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ৫ ডিসেম্বর বি গ্রুপের শীর্ষ দল ইংল্যান্ড খেলবে ‘এ’ গ্রুপের রানার্স আপ সেনেগালের বিপক্ষে।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.