প্রবাসী আয়ে বাড়ছে শঙ্কা

ডলার সংকটের মধ্যে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরের শুরুতে আশা দেখালেও ধারাবাহিকভাবে কমছে প্রবাসী আয়। গেল সেপ্টেম্বর মাসের ধারাবাহিকতায় চলতি মাসেও প্রবাসী আয়ে চলছে ভাটার টান। অক্টোবর মাসের প্রথম ১৩ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স আসার এই হার শঙ্কায় ফেলছে দেশের অর্থনীতিকে। বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, চলতি মাসে রেমিট্যান্স ১৬০ কোটি ডলারের আশে-পাশে থাকতে পারে।

করোনার মধ্যেও রেকর্ড রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলো প্রবাসীরা। এর পরিমাণ হুট করে কমতে শুরু করে। সম্প্রতি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠানোর হার বেশ কমেছে। রেমিট্যান্স ভাটায় দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে চোখ রাঙাচ্ছে ডলার সংকট। এ সংকট ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারণ করছে। এর সমাধান না হলে আগামীতে দেশের অর্থনীতি আরও বড় সমস্যার মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা শাখার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন অর্থসূচককে বলেন, রেমিট্যান্স কমার সঙ্গে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের নতুন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির একটি সংযোগ আছে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০৮ টাকা। চলতি অর্থ বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে ১০০ কোটি ডলার এসেছে। সুতরাং ২০০’র পথেই ছিলো। রেমিট্যান্সের ডলারের নতুন দামের পদ্ধতি চালু হয় সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ। সেপ্টেম্বরের শেষ দুই সপ্তাহে এসেছে ৫০ কোটি ডলার। অক্টোবরের প্রথ দুই সপ্তাহে দেখলাম এসেছে ৭৭ কোটি ডলার। ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে রেমিট্যান্সের এই নেতিবাচক প্রভাব। এছাড়া আর কোন কারণ দেখতে পাই না।

তিনি আরও বলেন, খোলা বাজারেও ডলারের দাম ১০৯ থেকে ১১১ টাকা রয়েছে। প্রবাসীরা হুন্ডি মার্কেটে ১২০ টাকাও পেয়ে থাকে। এজন্য প্রবাসীরা বৈধ উপায় ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠাতে চায় না। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন যায়গায় ডলারের বিভিন্ন দাম। ডলারের এই দাম একিভূত করতে না পারলে এসব সমস্যার সমাধান হবে না। তাই মানুষ যেখানে বেশি দাম পাবে সেদিকেই ঝুঁকবে।

সমস্যা সমাধানের বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বাহিরের দেশে আমাদের শ্রমিকের সংখ্যাও কমছে না। এছাড়া যেসব দেশে শ্রমিকরা যাচ্ছেন সেখানে মজুরির হার কমছে না এবং বেকারত্বও বাড়ছে না। গত বছর ৬ লাখ ১৭ হাজার শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এ বছর আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখের মতো গেছে। গত দেড় বছরে ১৪ লাখের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক যুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ৬০ শতাংশ শ্রমিক গেছে সৌদি আরবে এবং ১০ শতাংশ গেছে দুবাইতে। এরা অধিকাংশ বর্তমান সংকটের মধ্যেও সুবিধাভোগী দেশগুলোতে রয়েছে। এরা সবাই মূল্যস্ফীতির সুবিধা ভোগ করেছে। এসব দেশে বেকারত্ব ও মজুরির সমস্যা নেই। তাহলে আমাদের রেমিট্যান্স না বেড়ে কমার কোন কারণ নেই। এরপরেও বৈদেশিক মুদ্র বর্ডার ক্রোস করছে না। এতে আমরা রিজার্ভে কোন সুবিধা পাচ্ছি না। তাই ডলারের দাম সমন্বয় করতে হবে। দাম সমন্বয় না হলে হুন্ডি প্রাধান্য বেশি পাবে।

এদিকে সম্প্রতি অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য অভিন্ন দাম ঘোষণা করেছে। এক্ষেত্রে রেমিট্যান্সের ডলার ক্রয়ের ক্ষেত্রে ১০৮ টাকা দর বেধে দেওয়া হয়। অপরদিকে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠালে ডলার প্রতি ১২০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। এতে হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন অধিকাংশ প্রবাসীরা। এর ফলে বৈধ উপায় ব্যাংকে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৬৭ কোটি ২৭ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে এসেছিল ৫৪০ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। এর আগের ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রেমিট্যান্সে এসেছিলো ৬৭১ কোটি ৩২ লাখ ডলার।

সিঙ্গাপুর প্রবাসী সাব্বির রহমান বলেন, বর্তমানে সিঙ্গাপুরিয়ান ডলার পাঠালে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ৭০ টাকা ২০ পয়সা দেয়। অথচ হুন্ডিতে প্রতি হাজারে ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া ব্যাংকে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকতে হয়। তবে হুন্ডিতে খুব দ্রুত টাকা হাতে পাওয়া সম্ভব হয়।

মহামারীতে অনেকেই ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার মধ্যে পড়েছিলো। ফলে প্রবাসীরা তাদের সঞ্চয় করা সব অর্থ দেশে পাঠিয়েছিলো। এতে গত বছরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ হু হু করে বেড়ে যায়। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে দাড়িয়েছিলো। এরপরে আর রেমিট্যান্সে সুবাতাস লাগেনি। এভাবে ডলার সংকটে রিজার্ভের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

রফতানি আয় কমার পাশাপাশি রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি রিজার্ভে পড়ছে। চাপ সামাল দিতে ব্যাংকগুলোর কাছে ধারাবাহিক ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) ৬০ মিলিয়ন বা ৬ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এতে রিজার্ভ কমে দাড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে।

সৌদির কয়েকজন প্রবাসী বলেন, ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডিতে বেশি টাকা পাওয়া যায়। হুন্ডিতে টাকা পাঠালে বৃদ্ধ বাবা-মাকে লাইন ধরে ব্যাংকে দাড়িয়ে থাকতে হয় না। অল্প সময়ের মধ্যে পরিবারের সদস্যরা টাকা হাতে পায়। সৌদিতে বৈধ না হলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠানো সম্ভব নয়। এখানে প্রচুর অবৈধ বাংলাদেশি প্রবাসীরা আছেন। এরা সমবসময় আয় করা অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাঠায়।

দেশে যে কোনো ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে থাকে। এ সময় প্রবাসীরা বেশি অর্থ পাঠায়। এর প্রভাবে গত দুই ঈদেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে। তবে এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। গত বছরের শেষের দিকে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অবৈধ উপায়ে অর্থ পাঠানোর পথ আবারও খুলে যায়। চিকিৎসা, শিক্ষা এবং ভ্রমণ খাতে বিভিন্ন কারণে হুন্ডির চাহিদা বেশি থাকে। এর ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনার পরিমাণ কমেছে। এছাড়া মহামারী সংকট কেটে যাওয়ায় অনেক প্রবাসীরা আবারও অর্থ জমাতে শুরু করেছে। এসব কারণে সরকারে দেয়া প্রণোদনার পরও কমছে প্রবাসী আয়।

অর্থসূচক/ সুলাইমান/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.