অর্থনীতিতে আগামী ২ মাসের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে: গভর্নর

টানা কয়েক মাস টালমাটাল অবস্থার পর অবশেষে দেশের অর্থনীতি নিয়ে স্বস্তির খবর দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, মার্চের তুলনায় সাড়ে ২৬ শতাংশ কমেছে ঋণপত্র খোলা, বিপরীতে বেড়েছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। নিম্নমুখী মূল্যস্ফীতিও। আর এতে আগামী দুই মাসের মধ্যে অর্থনৈতিক চাপ কেটে গিয়ে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

বহস্পতিবার (৪ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স রুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার কারণে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া পদক্ষেপগুলো জানাতে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম ও সহকারী মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদসহ কর্মকর্তারা।

দায়িত্ব নেয়ার পর এটাই গভর্নরের প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন। এর আগে, গত ১২ জুলাই গভর্নর হিসেবে যোগ দেয়ার পর সেদিনই অনানুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন তিনি। ‘বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপসমূহ’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, চাহিদা নিয়ন্ত্রণ , সরবরাহ বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

এ সময় আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় চাপ আমদানি। মূল্যস্ফীতিও বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে ভালো অবস্থানে যাবে। করোনার সংক্রমণ থেকে বের হওয়ার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির যে সমস্যা দেখা দেয়, সেটি প্রকট করেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে রাশিয়ার হামলার পর পশ্চিমা দেশগুলোর পদক্ষেপে তেতে ওঠে জ্বালানির বাজারও। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার পর জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দরে ঊর্ধ্বগতি, খাদ্যপণ্যের সরবরাহ কমে গিয়ে বিশ্বে তৈরি হয় নতুন সংকট। এতে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত সব দেশেই দেখা দেয় ব্যাপক প্রভাব, যার বাইরে নয় বাংলাদেশও।

গভর্নর বলেন, গত এক যুগের স্থিতিশীল ও ঊর্ধ্বমুখী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ স্পষ্ট। ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে কমছে রিজার্ভ, ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন মূল্যস্ফীতিতে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে গ্যাস আমদানি না করতে সরকারের সিদ্ধান্তে ফিরে এসেছে এক যুগ আগের লোডশেডিং। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে আমদানি সীমিত করার পদক্ষেপের সুফলও মিলছে। আমদানি ব্যয় কমে আসছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি। বিশ্ব মন্দার জেরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চাপ কমাতে বাজারে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ, ডলারসহ টাকার সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে শক্তিশালী অর্থনীতির ভীত গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন তিনি। আর এতেই আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ বিলিয়নে, বিপরীতে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বেড়ে সব মিলিয়ে ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন ছাড়িয়ছে।

তিনি বলেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে কমবে মূল্যস্ফীতিও। কেননা অর্থ পাচার বন্ধসহ বাজারে টাকার জোগান বাড়াতে নজর রেখেছেন তিনি। আমদানির সময় ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ট্রেড ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা বের হয়ে যাচ্ছে- এমন প্রচারণা আলোচনায় আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য আমাদের বা কারও কাছে নেই। ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমে আপলোড করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি দল এটা পর্যবেক্ষণ করছে। কোনো ঋণপত্র সন্দেহজনক মনে হলে সেটা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।

আব্দুর রউফ বলেন, ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদে ঋণ বিতরণ খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ। ব্যাংকগুলো মূলত স্বল্পমেয়াদে ঋণ বিতরণ করে। কিন্তু আমাদের দেশে শক্তিশালী বন্ড মার্কেট না থাকায় ব্যাংকগুলোকে বাধ্য হয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণ করতে হচ্ছে। ফলে অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। শক্তিশালী বন্ড মার্কেট তৈরি হলে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের সমস্যা দূর হবে। বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রয়োজনীয় দীর্ঘমেয়াদী ঋণ বন্ড মার্কেট থেকে তুলবে। আর ব্যাংকগুলো তখন কেবল স্বল্পমেয়াদি ঋণ বিতরণ করতে পারবে। এটা যদি করতে পারে তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণও কমে আসবে।

গভর্নর সুস্পষ্ট জানান, ঋণের সুদ কমানোর বিষয়ে আপাতত সিদ্ধান্ত নেই, এর কারণ ব্যাখা করে তিনি বলেন, ঋণের এক অংক সুদহার ৯ শতাংশ তুলে দিলে সুদহার আরও বেড়ে যাবে। গত তিন বছরের মধ্যে গত বছর বেসরকারি ঋণ দুই অংকের ঘর অতিক্রম করে। বেসরকারি ঋণের বাড়া মানে বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। এই মূহুর্তে ঋণের সুদহার উঠিয়ে নিলে বেসরকাারি খাতের বিনিয়োগ অনেক কমে যাবে। ফলে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে সেটা ব্যাহত হবে। বিনিয়োগ কমে যাবে৷ এখন ব্যাংকে তারল্য সংকট আছে। এর মূল কারণ সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এটার মানে ৭২ হাজার কোটি টাকা মার্কেট থেকে ওঠে আসছে। এ টাকা যতি মার্কেটে ফিরে যায় তাহলে তারল্য সংকট কেটে যাবে। তখন ঋণের সুদহার তুলে দেয়ার প্রস্তাব আর কার্যকর থাকবে না। আমরা ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করছি।

সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংক খাতে একক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ, মালিকদের কাছে এমডিদের নতজানু মনোভাব আর অনাস্থার বিষয়টিও সামনে আসে। গভর্নরের কাছে প্রশ্ন ছিল, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে পুরো ব্যাংক খাত, তারা নিয়ন্ত্রণ করছে এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, কে কোন ব্যাংকের মালিক সেটা আমার দেখার বিষয় না। এটা আমার দায়িত্বও না। ব্যাংক যদি শক্তিশালী হয় তা হলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট কে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। পর্ষদ কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। এখানে চাপ বলে কিছু নেই। আইনের মধ্যে থেকে কাজ করছে কিনা সেটাই প্রধান। ব্যাংকের সুশাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের জিরো টলারেন্স নীতি বহাল থাকবে বলেও জানান তিনি।

অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আমানতকারীদের টাকা ফেরত পাচ্ছে না। তবে বর্তমানে কিছু ব্যাংকের উপরও এমন অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এসব ব্যাংকের টাকা রেখে আমানতকারী ফেরত পাবে না এমন পরিস্থিতি হলে কি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, একশ্রেণির আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনাস্থা এসেছে। আমরা চাই ব্যাংকের প্রতি যাতে তা না আসে। সে জন্যই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা আগে ব্যাংকগুলোয় আস্থা আনতে কাজ করছি। ব্যাংকের পরই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হাত দিতে চাই। আমানতকারীদের টাকা যেন নিরাপদ থাকে সেজন্য আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি।

তিনি আরও জানান, অনিয়ম পেলে মিলবে কঠোর শান্তি। গ্রাহকদের ফেরাতে দুর্বল দেশ ব্যাংককে সহায়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একটি ব্যাংক খারাপ হলে অন্যটির ওপর এর প্রভাব পড়ে। আমরা কোনো ব্যাংক বন্ধের পক্ষে না, আমানতকারী যেন তার টাকা ফেরত পান সেটা নিশ্চিত করতে চাই। সব ব্যাংক ব্যবসা করবে, লাভ করবে, বাজারে টিকে থাকবে, এটা আমরা চাই।

অর্থসূচক/এএইচআর/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.