খোলা বাজারেও বাড়ছে ডলারের দাম

ব্যাংকের পাশাপাশি খোলা বাজারেও বাড়ছে ডলারের দাম। খোলা বাজারে ডলারের দাম ১০৩ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বৃহষ্পতিবার (২১ জুলাই) খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ওঠে ১০৩ টাকা। যা আগের দিন বুধবার ছিল ১০২ টাকা পর্যন্ত। এতে বিপাকে পড়েছেন পর্যটক ও চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী যাত্রীরা।

এদিকে, আন্তঃব্যাংক রেটও এদিন কিছুটা বেড়েছে। অর্থাৎ বৃহষ্পতিবার (২১ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ডলারের রেট ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা গতকাল পর্যন্ত ছিল ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করলেও ব্যাংকগুলো নগদ ডলার বিক্রি করছে এর চেয়ে চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি দরে।

এ হিসাবে আন্তঃব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের দামের ব্যবধান এখন ৮ টাকা ৫৫ পয়সা। ব্যাংকের সঙ্গে খোলা বাজারের ডলারের পার্থক্য বেশি হওয়ায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স আরো কমে যাওয়ার আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এর আগে ব্যাংকের সঙ্গে খোলা বাজারের পার্থক্য কখনোই এতো বেশি হয়নি।

রাজধানীর মতিঝিল ও পল্টন এলাকার মানি চেঞ্জারসহ খোলাবাজারে মঙ্গলবার (১৪ মে) মার্কিন ডলার ১০২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০৩ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। যা আগের দিন বুধবার বিক্রি হয়েছে ১০২ টাকা থেকে ১০২ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত। এর ফলে বিদেশগামী যাত্রী, রোগী ও পর্যটকদের খরচ বেড়ে গেছে।

জানা গেছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তারই প্রভাব পড়ছে দেশে। ফলে জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে সার্বিকভাবে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ পড়েছে। আবার রপ্তানি বাড়লেও তা আমদানির তুলনায় অনেক কম। আবার প্রবাসী আয়ও খুব বেশি বাড়ছে না। ফলে দেশে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। এতে বেড়ে গেছে প্রধান আন্তর্জাতিক মুদ্রাটির দাম।

এছাড়া, করোনার কারণে দীর্ঘসময় মানুষ দেশের বাইরে যাননি। ফলে এখন করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় অনেক মানুষ চিকিৎসার প্রয়োজনে বা ঘুরতে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। ফলে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়েছে। সেই অনুপাতে সরবরাহ কম থাকায় ডলারের দামও অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, যিনি যে দেশে যাচ্ছেন, তার জন্য সেই দেশের মুদ্রা সহজলভ্য করা হলে তা ডলারের ওপর চাপ কমাতে পারে।

এদিন, মতিঝিলে ডলার কিনতে আসা তাসলিমা বেগম বলেন, আমার বাবা চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে যাবেন। সেজন্য প্রয়োজনীয় ডলার কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু ডলারের দাম অনেক বেশি হওয়ায় যতটুকু কিনতে চেয়েছিলাম তার থেকে কম কিনতে হয়েছে। এতে চিকিৎসার ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ডলারের দাম কমানোর অনুরোধ জানান তিনি।

মানি চেঞ্জার ও খোলাবাজারের মুদ্রা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে অনেক বেশি সংখ্যাক মানুষ দেশের বাইরে ঘুরতে বা চিকিৎসার কাজে যাচ্ছেন। ফলে ডলারের চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই তুলনায় ডলারের সরবরাহ অনেক কম।

তাদের মতে, সাধারণত বিদেশ থেকে যারা আসেন, তারা সঙ্গে করে ডলার নিয়ে আসেন। নগদ ডলারের যোগানের এটাই একমাত্র মাধ্যম। আর দেশের মানুষের হাতে যা থাকে, তা অনেক সময় বিক্রি করেন। এ ছাড়া বিদেশি পর্যটকেরা ডলার বিক্রি করে টাকা নেন। কিন্তু এখন ডলার বিক্রি করতে খুব বেশি গ্রাহক আসেন না। ব্যবসায়ীরা নিজেদের হাতে থাকা ডলার বিক্রি করছেন। অর্থাৎ খোলাবাজারে চাহিদার তুলনায় যোগান কম হওয়ায় ডলারের দাম বাড়ছে।

জানতে চাইলে যমুনা মানি চেঞ্জারের স্বত্তাধিকারী আনিসুজ্জামান অর্থসূচককে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের দাম বেশি। এর কারণ হচ্ছে বাজারে ডলারের সরবরাহ অনেক কম। কিন্তু সেই তুলনায় চাহিদা অনেক। এ কারণেই দাম বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়লেই দাম কমে আসবে। বিদেশ থেকে পকেটে করে ডলার এলেই বাজারে ডলারের ওপর চাপ কমবে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, খোলা বাজারে নগদ ডলারের দাম বাড়ার সঙ্গে রফতানি ও প্রবাসী আয়ের কোন সম্পর্ক নেই। তাদের কাছে কেউ ডলার বিক্রি করতে এলে তারা তা কিনে রাখেন। এরপর সেই ডলার বিক্রি করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জায়গায় স্থির ছিল ডলারের দর। এরপর থেকেই শক্তিশালী হতে থাকে ডলার; বিপরীতে প্রতিনিয়ত দুর্বল হচ্ছে দেশীয় মুদ্রা টাকা।

হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এই সাড়ে ১১ মাসে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর বেড়েছে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এদিকে, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ আমদানিতে লাগাম টানতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও দামে লাগাম পরানো যাচ্ছে না। অস্থির ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের চাহিদা বেশি হওয়ায় ধীরে ধীরে দাম বাড়াচ্ছে। সেইসাথে রিজার্ভ থেকেও প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৮ দিনে (১ থেকে ১৮ জুলাই) ৬৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা)। এর ফলে রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে।

এভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডলারের বাজার।

ডলার-সংকট নিরসনে গত বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) একসঙ্গে চারটি সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেগুলো হলো ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা (এনওপি) হ্রাস, রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন, ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তর। এছাড়া ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের বেসরকারি যে কোনো আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

এর আগে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশভ্রমণ বন্ধ করা হয়। দামি গাড়ি, প্রসাধনী, স্বর্ণালংকার, তৈরি পোশাক, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য বৈদ্যুতিক সামগ্রী, পানীয়সহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে ব্যাংকঋণ বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া, আমদানি নির্ভর উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে যেগুলো জরুরি নয়, সেগুলোর বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।

সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগের ফলে আমদানি ব্যয় কিছুটা কমে ডলারের বাজারে চলমান অস্থিরতাও কেটে যাবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.