বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ২০২৪ সালের পর চাপ বাড়বে: সিপিডি

বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে স্বস্তিদায়ক অবস্থানে থাকলেও ২০২৪ সালের পর দায়-দেনার চাপ বাড়বে বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডি।

বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) ২০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে ‘বাংলাদেশের বৃহৎ বিশটি মেগা প্রকল্প: প্রবণতা ও পরিস্থিতি’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এই মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ২০১০ সালের পর আমরা অনেকটাই স্বস্তির জায়গায় ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। রাজস্ব আয় প্রত্যাশিতভাবে হচ্ছে না। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার অভাব আছে। ঘাটতি আছে প্রকল্প বাস্তবায়নে।

এসব কারণে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। ওই সব প্রকল্পের কাজও প্রায় শেষ হওয়ার পথে। ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়বে।

এ জন্য সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে সিপিডি বলেছে, এখন থেকে একটি কর্মপরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন, কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়। তা না হলে ভবিষ্যতে জটিলতা তৈরি হতে পারে।

এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনে দায়-দেনা পরিশোধে পুনঃতফসিল করা যেতে পারে। যদি ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর দরকার হয়, সেটিও করা যেতে পারে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার কথা বলেছে সিপিডি।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, যেসব উৎস থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে যেভাবে বাংলাদেশের দায়-দেনা বাড়ছে এবং ঋণ পরিশোধের সময় এগিয়ে আসছে, তা আগামী দুই বছর পর বাংলাদেশের জন্য আর্থিক খাতে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

ড. দেবপ্রিয় মনে করেন, মেগা প্রকল্প যতই যৌক্তিক হোক না কেন, তার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতকে উপেক্ষা করা চলবে না। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বাড়িয়ে এ সব খাতে বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।

সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, ২০ মেগা প্রকল্পে এ পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে ৭০ বিলিয়ন ডলার। এর দুই-তৃতীয়াংশই বিদেশি ঋণ। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগ ভৌত অবকাঠামো। এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৫০ শতাংশ। বিদ্যুৎ খাতে হয়েছে ৩৫ শতাংশ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ১২ শতাংশ।

সিপিডি বলেছে, ২০১০ সাল থেকে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি প্রকল্প এসেছে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল সময়ে।

২০ প্রকল্পের মধ্যে ১৩টি এসেছে এই সময়। তবে দুই-তিনটি প্রকল্প ছাড়া বাকিগুলোর বাস্তবায়ন ভালো নয়। বিশেষ করে ২০১৮ সালের পর যে সমস্ত প্রকল্প এসেছে সেগুলোর বাস্তবায়ন নগণ্য।

ড. দেবপ্রিয় জানান, আাগামী ২০২৮ সালের মধ্যে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়নে কাজ শেষ হওয়ার কথা। যেভাবে কাজ এগোচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে আরও সময় নেবে।

তবে দেবপ্রিয় মনে করেন, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে বৈদেশিক অর্থায়ন সংগ্রহ করা হয়েছে, এগুলো ভালো। কারণ, ঋণের সুদের হার কম ও পরিশোধের সময়ও লম্বা। ফলে ঋণ পরিশোধে সরকারের উপর চাপ কম পড়বে।

ড. দেবপ্রিয়র মতে, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যমত আছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যুক্তিও রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় বলে, যদি মানসম্মত সমীক্ষা না থাকে, সমন্বয়ের অভাব থাকে, বাস্তবায়নের ঘাটতি থাকে, কাজ শেষ হতে সময় বেশি লাগে, দুর্নীতি হয়, সামষ্টিক অর্থনীতি দুর্বল থাকে, তাহলে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সুফল আসে না। বহু দেশে অনেক মেগা প্রকল্প বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সুতরাং বাংলাদেশে এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।

ড. দেবপ্রিয় জানান, এসব সমস্যার সমাধানে অনেক দেশ আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের কাছে গেছে। বাংলাদেশও আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। এটা ইতিবাচক দিক।

তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী যদিও এ মুহূর্তে টাকা না নেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু আমি মনে করি, চলতি লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য (ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট) আইএমএফ-এর এর কাছ থেকে ঋণ নেওয়া উচিত বাংলাদেশের। কারণ আমাদের সমস্যা কোনো মৌসুমী সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে কাঠামোগত।’

এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, সাদা চোখে দেখতে পাচ্ছি দায়দেনার বড় ধাক্কা ২০২৪ ও ২০২৬ সালে আসবে। আমার বড় উদ্বেগের বিষয় সরকার ঋণের ৫০ শতাংশ নিয়েছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। সেটা পরিশোধ না করলে ব্যাংকগুলো তারল্য পাবে না। অন্যদিকে সেসব প্রকল্প শুরু হয়নি, অতি জরুরি না হলে তা স্থগিত করা প্রয়োজন। আর যেসব এগিয়ে চলেছে, কিন্তু ব্যয় কাঠামোর স্বচ্ছতা নেই, প্রকাশ্যভাবে দুর্নীতি কিংবা অতিমূল্যায়িত হয়েছে, সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। আর যেগুলো বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে সেগুলোর দায়দেনার সময় কাঠামোকে পুনঃতফসিলিকরণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।

আইএমএফর ঋণ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকার আইএমএফর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে, এটা ভালো দিক। আইএমএফর কাছে শুধু টাকার জন্য যেকোনো দেশ যায় না, তাদের মতো প্রতিষ্ঠান পাশে থাকলে বিশ্ববাজারে আস্থার জায়গা তৈরি হয়। সাহায্য যাই হোক। মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল থাকবে। আমি মনে করি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং মধ্যমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য আইএমএফ-এর কাছ থেকে টাকা নেওয়া উচিত।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘আগামীতে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে কিনা, সেটা নির্ভর করছে তখন ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের অবস্থা কী দাঁড়াবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেমন থাকবে, রপ্তানি কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে- এসব বিষয়ের উপর।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘আইএমএফ-এর কাছে শুধু টাকা চাওয়ার জন্য যাওয়া হয় না। তারা নীতি সংস্কার নিয়ে কথা বলে।

অর্থসূচক/এমএস/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.