ব্যাংকঋণে ঝুঁকছে সরকার

চড়া সুদের সঞ্চয়পত্র ছেড়ে আবার ব্যাংকঋণে ঝুঁকছে সরকার। তারই ফলশ্রুতিতে সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার যে ঋণ নিয়েছে, শেষ মাস জুনেই নিয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ।

অর্থবছরের শুরুতে সরকারের ব্যাংক নির্ভরতা কম ছিল। উল্টো আগের নেয়া ধার পরিশোধ করেছে সরকার। তবে, সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে যে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা গেল তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অর্থবছরের শুরু ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ঋণ ছিল ২৬ হাজার ৪৫০। আর শেষ মাস জুনে ঋণ নেয়া হয় ৪৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানি ব্যয় মেটাতে অর্থের চাহিদা বাড়ছে। উন্নয়ন ব্যয় চালিয়ে যেতেও দরকার অর্থ। তবে, চাহিদার বিপরীতে অভ্যন্তরীণ আয় কম। তাই বৈদেশিক ঋণ এবং ব্যাংক ঋণে ঝুঁকছে সরকার। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিলে সরকারকে অনেক বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয় বলেই সরকার ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। যদিও সরকারের ব্যাংকঋণ বেড়ে গেলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক থেকে এই মুহূর্তে সরকারের ঋণ তেমন সমস্যা না। অর্থবছরের শেষ দিকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে যায়। কারণ, বরাদ্দকৃত অর্থ সব ব্যয় করতে হয়। পাশাপাশি সুদের হার কমানোয় ও নানা কড়াকড়ি আরোপের কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সেখান থেকে আর আগের মতো ঋণ পাচ্ছে না সরকার; এ জন্য সরকার এবার ব্যাংকঋণে ঝুঁকেছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের ক্ষেত্রে সরকারকে সঞ্চয়পত্র নির্ভরতা কমাতে হবে। না হলে সুদ ব্যয় বাড়বে।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে সরকার। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয়া হয়। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে জোগান দেওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন তিনি।

আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ঘাটতির এই পরিমাণ আগের যে কোনো বছরের তুলনায় বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎস ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ে অর্থমন্ত্রীকে এই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। ফলে এই অর্থবছরে ব্যাংক থেকেই ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ধার করার পরিকল্পনা রয়েছে। এবার বিদেশ থেকে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৪৫ কোটি ঋণ করার পরিকল্পনা করেছে সরকার।

এদিকে, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকারের ব্যাংক ঋণের নিট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৮৭ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত অর্থবছর ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার চাহিদা ছিল বেশ কম। শুরুর দিকে সরকার ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল, পরিশোধ করেছিল তার চেয়ে বেশি। কিন্তু অর্থবছরের শেষে ব্যয় ব্যবস্থাপনায় যখন হিমশিম অবস্থা, তখন ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয় সরকার।

২০২১-২২ অর্থবছরের ৫ মাস অর্থাৎ নভেম্বর শেষে সরকার প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে মোট ১৮ হাজার ৭৫৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ঋণ নেয় সরকার। কিন্তু এরপর সরকারের ব্যাংক ঋণ কমে যায়। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার। এরপর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের পরিমাণ হু হু করে বাড়তে থাকে। দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ব্যাংক থেকে মোট ঋণ দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৪৮৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

৩০ জুন শেষে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি দুই লাখ ৭৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ৩০ জুন শেষে যা ছিল ২ লাখ ২ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত অর্থবছরজুড়ে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ ৭২ হাজার ৭৪৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া হয়েছে ৪১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা।

অন্যদিকে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। ১১ মাসে অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সরকার ঋণ নিয়েছে ৫৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। করোনা মহামারিতে মানুষের আয় কমে গেছে। তা ছাড়া মুনাফার ওপর করের হার বৃদ্ধি এবং নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের পর সঞ্চয়পত্র বিক্রিও কমে গেছে। ফলে, সমাপ্ত অর্থবছরের জুলাই-মে শেষে পুরোনো সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা।

যা ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ হাজার ২২৯ কোটি টাকা কম। যা শতকরা হিসাবে ৫১ শতাংশ। সেই হিসেবে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। ওই অর্থবছরে ১১ মাসে নিট বিক্রি ছিল ৩৭ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।

অর্থসূচক/এএইচআর/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.