‘বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য নীতি সহায়তার ঘাটতি’

এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য নীতি সহায়তার ঘাটতি দেখা গিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান। তিনি বলেন, বাজারের উন্নয়নে ডিএসই’র পক্ষ থেকে ৭টি প্রস্তাব দেওয়া হলেও মাত্র ১টি প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সেটাও আবার আংশিক।

মঙ্গলবার (২১ জুন) ‘বাজেট ২০২২-২৩ ইমপ্লিমেনটেশনস ফর দ্য ক্যাপিটাল মার্কেট’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। পুঁজিবাজারের উপর ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ক্যাপিটাল মার্কেট (বিআইসিএম) এই সেমিনারের আয়োজন করে। এসময় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইসিএমের রিসার্চ ফেলো ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুবর্ণ বড়ুয়া।

বিআইসিএমের নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ড. মাহমুদা আক্তারের সঞ্চালনায় এসময় আরো বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলালউদ্দিন, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট স্নেহাশীষ বড়ুয়া এফসিএ এবং ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) সভাপতি জিয়াউর রহমান প্রমুখ।

ইউনূসুর রহমান বলেন, এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারের প্রতি সরকার মনোযোগ কম দিয়েছে। আমরা ৭টি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু একটি আমলে নিয়েছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্পোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে। তবে এর মধ্যেও বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে। যেমন যে সব কোম্পানির ন্যুনতম ১০ শতাংশ শেয়ার আইপিও’র মাধ্যমে বাজারে এসেছে এবং এক বছরে নগদ লেনদেন ১২ লাখ টাকার বেশি হতে পারবে না। ফলে এই শর্ত পূরণ করে কর সুবিধা নেওয়া কঠিন।

তবে তিনি বলেন, বিভিন্ন সমালোচনা সত্ত্বেও পুঁজিবাজার আজকে যে অবস্থানে চলে এসেছে, এর পেছনে সরকারের নীতি সহায়তা রয়েছে।

আসিফ ইব্রাহিম বলেন, পুঁজিবাজারে কাঠামোগত সংস্কারে জোর দিতে হবে। বাজার দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করতে সরকারি লাভজনক কোম্পানি তালিকাভুক্তি জরুরি। এছাড়া ব্রোকারেজহাউসগুলোর লেনদেনে কর কমানোর সুপারিশ করেন তিনি।

অধ্যাপক হেলাল বলেন, বৈশ্বিক সংকট বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে নির্দিষ্ট কোনো খাতেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তালিকাভূক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির করহারের ব্যবধান সাড়ে ৭ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করার পক্ষে অনেকেই মত দিয়েছেন। কিন্তু আমি এর সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করি। এখানে শূন্য শতাংশ ব্যবধান রাখা হলে আমি খুশি হতাম। এতে পুঁজিবাজারে কোম্পানির অংশগ্রহণ বাড়লেও বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়বে না।

তিনি আরো বলেন, আস্থার সংকটের কারণেই বাজারে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আর পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট হয় কারসাজি ও সুশাসনের অভাবে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা সেটি দেখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, কালো টাকার বিনিয়োগের সুবিধা একা একটা পারসেপশন। এই সুযোগের আওতায় খুব বেশি টাকা পুঁজিবাজারে আসেনি। সুতরাং এটা থাকা না থাকা সমান বিষয়। চাহিদা এবং যোগানের নীতিমালাগুলো বিকেন্দ্রীকরণ করলে পুঁজিবাজারের সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সুবর্ণ বড়ুয়া বলেন, এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সরাসরি পদক্ষেপ কম। এছাড়াও বাজেট ঘাটতি মেটাতে যে এক লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংকঋণের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। এতে পুঁজিবাজারেও নানা ধরনের চাপ তৈরি হবে।

সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে অন্তত ১০ শতাংশ পুঁজিবাজার থেকে তোলা উচত মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাজেটে সরকারের এমন ঘোষণা থাকলে একদিকে পুঁজিবাজারের প্রতি সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা হবে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরাও আশ্বস্ত হবে।

স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, এতদিন ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেশনস ফান্ড (ডব্লিউপিএফ) এর চাদা কোম্পানির ব্যয় হিসেবে গণ্য হতো। এবারের বাজেটে সেটি তুলে দেওয়া হয়েছে। তাতে কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা কমে যাবে। কমবে ইপিএস ও লভ্যাংশ দেওয়ার সক্ষমতা।

জিয়াউর রহমান বলেন, বাজারে চাহিদা ও যোগানের মধ্য্যে ভারসাম্য রাখা জরুরী। ভাল শেয়ারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, নইলে বাজারের গভীরতা এবং অর্থনীতিতে এর অবদান বাড়বে না। সরবরাহের পাশাপাশি চাহিদা বাড়ানোর দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।

তিনি বলেন, একটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে নানা কমপ্লায়েন্স পরিপালন করতে হয়। এতে কোম্পানির পরিচাল ব্যয় বেড়ে যায়। কোম্পানির উপর নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বেড়ে যায় বলে কর ফাঁকি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই আকর্ষণীয় কর সুবিধা না পেলে ভাল কোম্পানিগুলো আইপিওতে আসতে আগ্রহী হয় না। এ কারণে তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে করপোরেট করহারের ব্যবধান বাড়িয়ে কমপক্ষে ১০ শতাংশ করতে হবে।

তিনি বলেন, যেসব কোম্পানির শেয়ার কারসাজি হচ্ছে, সেসব কোম্পানির প্রথম ১০ কর্মকর্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দেখলেই ধরা পড়বে। কারা কারসাজি করছে।

তিনি আরো বলেন, গত এক দেড় বছর পুঁজিবাজার যেভাবে উঠছে বা নামছে সেটা স্বাভাবিক নয়। সম্প্রতি কিছু কোম্পানির ৩-৪ গুণ শেয়ারের দাম বেড়েছে, কিন্তু কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। এখন ২ থেকে ৩ শতাংশ বাড়লেই নোটিশ দেওয়া হয়। এ কারণে লেনদেন কমছে। এখানে কিছু অনিয়ম হচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, শেয়ারের দাম ২০০-৩০০ ভাগ বেড়েছে। কিন্তু তারপরও নোটিশ দেওয়া হয়নি। বরং কিছু কোম্পানি ২০-৩০ শতাংশ বৃদ্ধিও পরই নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এটি যৌক্তিক নয়। বাজারে আস্থার সংকটে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে না।

অর্থসূচক/এমআর/এমএস/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.