প্রতি মাসেই বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন

প্রতি মাসেই বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে লেনদেন হয়েছে ৯৩ হাজার ৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। যা একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ লেনদেনের রেকর্ড। লেনদেনের পাশাপাশি গ্রাহক সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর আগের মাস মার্চে লেনদেন হয়েছে ৭৭ হাজার ২১২ কোটি টাকা। এর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে লেনদেন হয়েছে ৬৮ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। আর জানুয়ারিতে লেনদেন হয়েছে ৭৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে লেনদেন বাড়লেও পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে তা কিছুটা কমে যায়। এরপরের মাস মার্চে তা আবার বাড়তে থাকে, যা অব্যাহত রয়েছে এপ্রিল মাসেও।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চ মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয় ৭৭ হাজার ২১২ কোটি টাকা। আর পরের মাস এপ্রিল শেষে এই লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ১৫ হাজার ৮২০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, করোনা মহামারির মধ্যে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার অনেক বেশি বেড়েছে। জরুরি প্রয়োজনে সাধারণ ব্যাংকিংয়ের চেয়ে মোবাইলে ব্যাংকিংয়ের সহজলভ্যতা মানুষকে আকৃষ্ট করছে। এতে দিন-দিন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি লেনদেনও বাড়ছে।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করা সহজ হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে খুব সহজেই যে কেউ মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। একইসঙ্গে টাকা লেনদেন করতে পারেন বাংলাদেশের যে কোনো স্থান থেকে। দেশের মধ্যে অসংখ্য ব্যাংক এজেন্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় লেনদেনের জন্য গ্রাহকদের ব্যাংকের শাখায় যেতে হয় না। এতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাহকদের সময় লাঘবের সঙ্গে যাতায়াত খরচও বাঁচে।

মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলেছেন, এক মাসে এত লেনদেন এর আগে কখনও হয়নি। শহর থেকে গ্রামে বা গ্রাম থেকে শহরে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় গ্রাহক সংখ্যার সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণও।

বিকাশ, রকেট, এমক্যাশ, উপায়সহ দেশে বর্তমানে ১৩টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবা (এমএফএস) দিচ্ছে। ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’ও একই ধরনের সেবা দিচ্ছে। তবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির এই সেবা উল্লিখিত হিসাবে এখনো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কেননা এটি এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পায়নি। নগদ’র হিসাব অন্তর্ভূক্ত করা হলে এপ্রিল শেষে লেনদেনের এই পরিমাণ হবে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। আর দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়াবে চার হাজার কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিল মাস শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩০ জন। এর মধ্যে গ্রামে ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৭৩ হাজার এবং শহরে রয়েছে ৫ কোটি ৩৫ লাখ ২০ হাজার গ্রাহক। এছাড়া নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৪১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৩৫ জন এবং মহিলা গ্রাহক ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৬৩ হাজার ২৪৮ রয়েছে। আর আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৭৭ হাজার ১৫২ জনে।

এছাড়া শুধু ‘নগদ’-এ গ্রাহক রয়েছে ৬ কোটি ২৫ লাখ। এ হিসাব যোগ হলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়াবে ১৮ কোটি ১৫ লাখ। এমএফএস এ গেল এপ্রিলে মোট ৩৭ কোটি ৯৮ লাখ ১ হাজার ৭১০টি লেনদেনের মাধ্যমে ৯৩ হাজার ৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। আলোচিত মাসজুড়ে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবগুলোতে টাকা জমা পড়েছে (ক্যাশ ইন) ২৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এ সময়ে উত্তোলন করেছে (ক্যাশ আউট) ২৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।

লেনদেন উৎসাহিত করতে সম্প্রতি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেনের সীমা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে এমএফএস এর গ্রাহকরা দিনে এজেন্ট থেকে ৩০ হাজার টাকা ও ব্যাংক হিসাব বা কার্ড থেকে ৫০ হাজার টাকা জমা করতে পারবেন। আগে দৈনিক ৩০ হাজার টাকার বেশি জমা করা যেত না। আর কার্ড থেকে টাকা জমার সীমা নির্দিষ্ট ছিল না। এছাড়া একজন গ্রাহক আরেক জনকে মাসে ২ লাখ টাকা পাঠাতে পারবেন। আগে এ সীমা ছিল ৭৫ হাজার টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, বর্তমানে দেশের সামগ্রিক পরিশোধ ব্যবস্থায় এমএফএস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কোভিড-১৯-এর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এমএফএসের আওতা ও লেনদেনের ব্যাপ্তি প্রসারের পাশাপাশি এ মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আর্থিক সহায়তা প্রদান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। একই সঙ্গে স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে এমএফএস ব্যবহারের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে এবং ডিজিটাল লেনদেন উৎসাহিত করতে এমএফএসের ব্যক্তি হিসাবের লেনদেনের সীমা বাড়ানো হয়েছে।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে শুধু লেনদেন নয়, যুক্ত হচ্ছে অনেক নতুন নতুন সেবাও। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল অর্থাৎ সেবা মূল্য পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, বেতন-ভাতা দেওয়া, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ রেমিট্যান্স পাঠানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা দেওয়া হচ্ছে।

প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। কেননা মোট গ্রাহকের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে গ্রামে ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৭৩ হাজার এবং শহরে রয়েছে ৫ কোটি ৩৫ লাখ ২০ হাজার গ্রাহক। এছাড়া নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৪১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৩৫ জন এবং মহিলা গ্রাহক ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৬৩ হাজার ২৪৮ রয়েছে।

মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন আর শুধু টাকা পাঠানোতেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং এর মাধ্যমে দৈনন্দিন কেনাকাটা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ বিভিন্ন বিল পরিশোধ, স্কুল-কলেজের বেতন, বীমার প্রিমিয়াম এবং মোবাইলে রিচার্জসহ নানা ধরনের সেবা মিলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। এর পরই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং বাজারের সিংহভাগই বিকাশের দখলে।

অর্থসূচক/এমএস/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.