বাজেট আশাব্যঞ্জক, তবে বাস্তবায়ন কঠিন হবেঃ বিসিআই সভাপতি

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)এর সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেছেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ঘোষিত বাজেট আশাব্যঞ্জক হলেও সুশাসন, যথাযথ মনিটরিং, দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও যথাযথ পরিকল্পনা নিশ্চিত করা না গেলে বাস্তবায়নে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে।

আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের উপর দেওয়া প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন।

বিসিআই সভাপতি বলেন, বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন বর্তমান সংকটময় বিশ্ব অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাবিত বাজেটে তৈরি পোশাক শিল্পের ন্যায় সব ধরনের রপ্তানিমুখী কোম্পানির করহারও ১২ শতাংশ করা হয়েছে, যা বিসিআই এর দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন।

তবে রপ্তানি ক্ষেত্রে উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ প্রস্তাব বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে রপ্তানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ পূনর্বহাল করা প্রয়োজন।
প্বিসিআই সভাপতি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই প্রস্তাাবিত বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা উল্লেখ করা হলেও তা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরী। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রণে আয়ের জনগোষ্ঠির জন্য রেশনিং ব্যবস্থা জোরদার করা এবং বাজেটে ৫০ লাখ পরিবারকে ১৫ টাকা দরে চাল সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। আমরা এই চালের দর পূর্বের ন্যায় ১০ টাকায় নির্ধারনের প্রস্তাব করছি।

বিসিআই মূলত তরুণ শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টি, মাইক্রো ও স্মল শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিল্পায়নের প্রসার নিয়ে কাজ করে চলেছে। বিসিআই মনে করে মাইক্রো ও স্মল শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি, সকল ধরনের ইউটিলিটির উপর মূসক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করছে। স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের টার্নওভার করহার শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ করায় আমরা স্বাগত জানাই। তরুণ উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের জন্য বাজেটে বিশেষ তহবিল গঠন করে তহবিল বিতরনের জন্য সুষ্ঠ নীতিমালা প্রনয়নের প্রস্তাব করছি।

আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর ২.৫% কমানো হয়েছে, যা বিসিআই স্বাগত জানায়। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্তারোপ করা হয়েছে যা বাস্তাবায়ন কষ্টসাধ্য।

মূল্যস্ফীতি ও জীবন যাত্রার ব্যয় বিবেচনায় আগামী কর বছরে ব্যক্তি শ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেন তিনি। কর ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ, দ্রুত, আধুনিক, যুগোপযোগী হয়রানিমূক্ত এবং সকলকে কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কর ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরুপে ডিজিটাল করে কর এসেসমেন্ট সিসটেম ফ্রেন্ডলি সহজ করার প্রস্তাব করছি। যার ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং সকলে কর প্রদানে উৎসাহিত হবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে শিল্পে কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে কর ৭% থেকে কমিয়ে ৪% এবং পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে কর ৭% থেকে কমিয়ে ৫% করা হয়েছে। উৎসে কর সমন্বয়যোগ্য বিধায় আমরা এ কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব পূনব্যক্ত করছি কারন এ কর ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি করে। এছাড়াও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ও অগ্রিম কর (এটি) বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করছি।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা (মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশ) এবং টানা তৃতীয় অর্থবছরে চিকিৎসা গবেষণা খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করায় মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। তবে করোনাভাইরাস টেস্টিং কিট, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) উৎপাদন করার কাঁচামাল আমদানির ওপর বিদ্যমান শুল্ককর মওকুফের সুবিধা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে যা পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব করছি।

স্টীল পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত এইচ আর কয়েল ও জিংক এলয় জাতীয় কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে কর হার ৫% থেকে কমিয়ে ৩% করা হয়েছে। এবং বাংলাদেশী পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের আয় ২০৩০ সাল পর্যন্ত করমুক্ত কারায় এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই।

কোভিড-১৯ জনিত কারনে কর্মহীনতা ও আয়- হ্রাস কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বয়স্ক ভাতা কর্মসূচী, প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচী, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচী প্রভৃতির আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে যা ইতিবাচক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান প্রক্রিয়াকে গতিশীল করবে বলে বিসিআই মনে করে।

দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নজর দেয়া হয়েছে। মানব সম্পদকে সার্বিকভাবে উন্নয়ন করা হলে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা সহজিকরন করে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রস্তাব করছি।

মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা যা বিগত বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১২.১২% বেশি। বাজেট ঘাটতি ২ লক্ষ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা যা জিডিপির ৫.৫% যা ৫% এর মধ্যে থাকা বাঞ্চনিয়। এ ঘাটতি পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা যার মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ১ লক্ষ ৬ হাজার ৩৩৫ টাকা ঋণ গ্রহণের কথা বলেছে। সরকার ব্যাংক খাত থেকে এ পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রাজস্ব ঘাটতি ও অর্থায়নসহ অন্যান্য বিষয়গুলো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। বিসিআই মনে করে বর্তমান সংকটময় বিশ^ পরিস্থিতে সকল ক্ষেত্রে অপচয় কমিয়ে আনতে হবে। খাদ্য পণ্য উৎপাদন, বিপনন এবং পরিবহন পর্যায়ে অপচয় ও চাদাবজি বন্ধ করা জরুরি। যানযট নিরসন, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা না করা ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পদ অপচয় কমিয়ে এনে সম্পদের সুষ্ট ব্যবস্থাপনা করা জরুরি।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.