বাড়বে আমদানি ব্যয়, ঝুঁকির মুখে পড়বে দেশীয় উৎপাদন শিল্প

বাজেট ২০২২-২৩

প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ফ্রিজ সংযোজন শিল্পকে উৎসাহিত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যহারে কমানো হয়েছে রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ সংযোজন শিল্পে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির শুল্ক। এতে দেশে ফ্রিজ উৎপাদন পর্যায়ে সংযোজনকারী বা অ্যাসেম্বলারদেরকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আমদানি ব্যয় কমাতে সরকারের নেয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হবে। পাশাপাশি দেশীয় পূর্ণাঙ্গ ফ্রিজ উৎপাদন শিল্পখাতের অগ্রগতিও ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বৃহস্পতিবার (৯ জুন ) ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ও বাজেটোত্তর সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ধারণা সামনে রেখে দেশীয় পণ্য উৎপাদনকে উৎসাহিত করেছেন। সেইসঙ্গে নিরুৎসাহিত করেছেন বিদেশি পণ্যের আমদানিকে। তবে অর্থমন্ত্রী যে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ গুরুত্ব দিচ্ছেন তার প্রতিফলন বাজেটে দেখা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এদিকে বাজেট উপস্থাপনের পর অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন (এসআরও) জারি করেছে । এতে রেফ্রিজারেটরের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো দুটি ক্যাটাগরি দেখা গেছে। এসআরও অনুযায়ী রেফ্রিজারেটরের প্রধান অংশ (মেইন পার্টস) এবং যে কোনো দুইটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ উৎপাদন করলে কোনো প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরি-১ এর উৎপাদক হিসেবে গণ্য হবে। অন্যথায়, ফ্রিজের বডি কেবিনেট উৎপাদন করলে (বাকিটা আমদানি করে) রেফ্রিজারেটর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরি-২ হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে অতি অল্প বিনিয়োগ এবং লোকবল ব্যবহার করেই তারা উৎপাদকের সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

এতে করে যেসব প্রতিষ্ঠান বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে রেফ্রিজারেটরের সকল যন্ত্রাংশ তৈরি করেন, তাদের সঙ্গে সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য থাকবে না। ফলে স্থানীয় রেফ্রিজারেটর শিল্পে বড় বিনিয়োগ আসবে না। দেশীয় উদ্যোক্তারা পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনমুখী শিল্পের পরিবর্তে সংযোজন শিল্প স্থাপনে বেশি আগ্রহী হবে। এছাড়া দেশে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ নষ্ট হবে। এর বিপরীতে বাড়বে আমদানি ব্যয় । এতে ব্যয় হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা যা সরকারের শিল্প সহায়ক নীতি এবং অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার সঙ্গে সাংর্ঘষিক। এতে করে রেফ্রিজারেটরে প্রকৃত উৎপাদনকারী শিল্পের পরিবর্তে শিল্প উৎসাহিত হবে। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা দরকার বলে অভিমত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, এই বাজেট প্রস্তবনায় সুফল পাবেন ফ্রিজ উৎপাদন পর্যায়ে স্থানীয় সংযোজনকারীরা । এতে করে দেশীয় ফ্রিজ উৎপাদন সংযোজন শিল্পে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি্র পরিমাণ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এটা ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে সরকারের নেয়া আমদানি ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিপরীত।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সরকারের দেয়া শিল্পবান্ধব সহায়ক নীতি ও কর সহায়তায় উৎপাদনশীলতার দিকে এগিয়ে গেছে দেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য শিল্পখাত। বর্তমানে দেশে ফ্রিজ, টিভি, এসির মতো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের পুরোপুরি উৎপাদনমুখী বেশকিছু শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে কারখানায় ব্যাপক পরিসরে অত্যাধুনিক সব মেশিনারিজ স্থাপনের মাধ্যমে ফ্রিজ ও আনুষঙ্গিক সকল যন্ত্রাংশ এখন দেশেই তৈরি করছে।

স্থানীয় বাজারে ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি পণ্যের সিংহাভাগ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছেন এ খাতের উৎপাদনমুখী দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা । শুধু তাই নয় দেশে তৈরি উচ্চ গুণগতমানের ফ্রিজ এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশীয় ফ্রিজ উৎপাদন শিল্পের তৈরি ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাত পণ্য বিশ্ববাজারে ব্যাপক প্রশংসা পাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের ফ্রিজ ও ইলেকট্রনিক্স শিল্প যখন পুরোপুরি উৎপাদনশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এ খাতে অ্যাসেম্বলিং শিল্পোদ্যাক্তাদের উৎসাহিত করা ঠিক হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইফতেখার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে যেসব পণ্যের উৎপাদন সক্ষমতা আছে এবং সামগ্রিকভাবে জনগণের চাহিদা মেটাতে সক্ষম, সেসব পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অ্যাসেম্বলারদের সুবিধা দেয়া ঠিক হবে না।

অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সরকার বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে আসছে। দেশের অর্থনীতির জন্যও এটি ভাল। তবে উৎপাদন ভলিউম অনুযায়ী সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ যদি এ খাতে অনেক বেশি পণ্য যোগ হয়, তাহলে এক ধরনের সিদ্ধান্ত হতে পারে। অন্যদিকে এর মাধ্যমে যে পরিমাণ উৎপাদন বাড়তি যোগ হচ্ছে তার থেকে ফিনিসড প্রোডাক্ট উৎপাদকরা বেশি কন্ট্রিবিউট করছে, তাহলে তাদের সুবিধা বাড়ানো উচিত।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, সরকার ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’কে প্রমোট করতে চাচ্ছে। সরকারের মনোভাবটা হচ্ছে এমন যে- দেশের জন্য উৎপাদন করো, দেশেই উৎপাদন করো। এতে দেশে কর্মসংস্থান হবে। সকল পর্যায়ের উৎপাদকদের সুযোগ ও গুরুত্ব দেয়া ভালো। তবে কিছুক্ষেত্রে এমন নীতিমালা দরকার যেন দেশেই কিছু পণ্যের উৎপাদন সক্ষমতা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ উৎপাদক তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় সরকারের পরিকল্পনায় থাকা উচিত। তিনি বলেন, দেশীয় কম্প্রেসর ও রেফ্রিজারেটর উৎপাদন শিল্পে সরকার যেহেতু নতুন উৎপাদকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, তার মানে সরকার এই খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে যারা স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান অবশ্যই তাদের প্রাধান্য দেয়া উচিত।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকার দেশীয় পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনমুখী ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তিপণ্য খাতে যে সুবিধা দিচ্ছে, এ খাতের উদ্যেক্তারা তার অনেক বেশি ফেরত দিচ্ছেন। এতে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিযোগ হচ্ছে, কর্মসংস্থান ও দেশীয় উৎপাদন বাড়ছে, আমদানি ব্যয় হ্রাস পাচ্ছে, বিপরীতে বাড়ছে রপ্তানি আয়। যা রাজস্ব খাতে অবদান রাখছে। অন্যদিকে এ খাতের অ্যাসেম্বলিং শিল্পে কর রেয়াত সুবিধা দিলে প্রকৃত উৎপাদকের পরিবর্তে অ্যাসেম্বলারের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে দেশের দেশের বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যয়ও বাড়বে। ফলে দেশের আমদানি ব্যয় কমাতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.