খেলাপি ঋণের ৮৮ শতাংশই আদায় অযোগ্য

ব্যাংকিং খাতে অব্যাহতভাবে বাড়ছে আদায় অযোগ্য মন্দমানের খেলাপি ঋণ। গত তিন মাসে এ মানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। যদিও এসময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের প্রায় পুরোটাই মন্দমানের ঋণ। যা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের সাড়ে ৮৮ শতাংশই মন্দমানের। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ এই পরিমাণ টাকা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কেননা মন্দ মানের খেলাপি ঋণের বেশিরভাগই বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে বিতরণ হয়ে থাকে।

২০২০ সাল জুড়ে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ঋণগ্রহীতা ঋণের কিস্তি শোধ না করলেও খেলাপি করা যাবে না, এমন সুবিধা পেয়েছেন গ্রাহকরা। এতে করে গত বছরে ঋণের কিস্তি না দিয়েও নতুন করে কোনো ঋণখেলাপি হয়নি; যার কারণে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে আসে। সেই সঙ্গে কমে আসে মন্দ মানের খেলাপি ঋণও।

এরপরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালেও এ সুবিধা পুরোপুরি বহাল না হলেও বকেয়া ঋণের মাত্র ১৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধে করলেই খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় চলতি বছর ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সব ধরনের শিথিলতা তুলে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ চলতি ২০২২ সালে সব ধরনের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের মেয়াদ বিভিন্ন হারে বাড়ানো হয়েছে। ফলে গত মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মন্দ মানের ঋণও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য মন্দমানের খেলাপির পরিমাণ ১ লাখ ৩৭৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা বা ৮৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তিন মাস আগে ২০২১ সালে ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দঋণের পরিমাণ ছিল ৯১ হাজার ৫৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বা ৮৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ টাকার অঙ্কের পাশাপাশি শতাংশের হিসাবেও বাড়ছে মন্দমানের খেলাপি ঋণ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যায়। কারণ এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে, যা তাদের নিট আয়ে প্রভাব ফেলছে। এতে দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি। ফলে বছর শেষে লভ্যাংশবঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনার ব্যয় বাড়ছে। মন্দ ঋণ বৃদ্ধির জন্য বাছবিচার ছাড়া ঋণ অনুমোদন, ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠনে ছাড় এবং সুশাসনের অভাবকে দায়ী করছেন তারা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অর্থসূচককে বলেন, কোনো ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ওই ব্যাংকের জন্য অগ্রিম সতর্কবার্তা। মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকের দুই ধরনের ক্ষতি হয়। একটি হচ্ছে, ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে, যা পরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে এই মানের ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। আর এটা করতে গিয়ে ব্যাংকের আয় কমে যায়। আর ব্যাংক তার আয় ঠিক রাখার জন্য সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ না করেই ঋণ বিতরণ করে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ শ্রেণীকরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। তা হলো নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ মান বা ক্ষতিজনক। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। এর মধ্যে নিম্নমান ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ প্রভিশন, সন্দেহজনকের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ মান বা ক্ষতিজনক ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে দেশের ৫৯টি ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৮.৫৩ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ১ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ টাকা। ওই অঙ্ক ছিল মোট বিতরণ করা ঋণের ৭.৯৩ শতাংশ। এ হিসাবে গত তিন মাসের ব্যবধানে মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।

অন্যদিকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ ছিল ৯১ হাজার ৫৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩৭৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ফলে গত তিন মাসের ব্যবধানে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা।

শতকরা অংশ হিসাবেও মন্দ মাণের ঋণ বাড়ছে প্রতিবছর। যেমন: ২০১৯ সালে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ মানের ঋণ ছিল ৮১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা বা ৮৬.৭৯ শতাংশ। করোনার বছর ২০২০ সালে খেলাপি ঋণ কমে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকায় নেমে আসায় মন্দ মানের খেলাপি ঋণ কমে দাঁড়ায় ৭৭ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। কিন্তু মোট খেলাপি ঋণের অংশ হিসেবে ২০২০ সালে মন্দ মানের খেলাপি ঋণের অংশ বেড়ে হয় ৮৬.৯৯ শতাংশ। ২০২১ চলতি বছরের মার্চে মোট খেলাপি ঋণের অংশ হিসেবে মন্দ ঋণের হার আরো বেড়ে ৮৮.১৬ শতাংশে উঠেছে। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ শেষে মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দমানের খেলাপি ঋণের হার বেড়ে হয়েছে ৮৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ রয়েছে বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৯৯ শতাংশই মন্দমানে পরিণত হয়েছে। মন্দ ঋণের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এ ব্যাংকের ৮০ দশমিক ৩৪ শতাংশই এখন মন্দমানের। তৃতীয় অবস্থানে থাকা পদ্মা ব্যাংকের মন্দ ঋণের অংশ ৬৭ শতাংশ। অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের ৫৪ দশমিক ৫২ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৪১ দশমিক ৪৭ শতাংশ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৩৩ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ, সোনালী ব্যাংকের ১৭ দশমিক ২৬ শতাংশ, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকের ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ১৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ, হাবিব ব্যাংকের ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ওয়ান ব্যাংকের ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

এদিকে, গত মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ৮টি ব্যাংক। এ তালিকায় আছে সরকারি খাতের ৪টি ও বেসরকারি খাতের ৪টি। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.