কাটছেই না বৈদেশিক মুদ্রার সংকট

দেশের মুদ্রাবাজারে টাকার বিপরীতে ডলারের পাশাপাশি অন্যান্য মুদ্রার দামও বেড়ে গেছে। দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে দিরহাম ও রিয়াল। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন চিকিৎসার কাজে বিদেশগামী যাত্রী, হজযাত্রীসহ বিভিন্ন কাজে বিদেশে যাওয়া যাত্রীরা। কেননা এসব মুদ্রার দাম বাড়ায় তাদের খরচও অনেক বেড়ে গেছে।

রাজধানীর মতিঝিলের মানি চেঞ্জারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলারের দাম ১০৪ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হওয়ার পরে গত কয়েকদিনে তা কিছুটা কমেছে। যা বুধবার (২৫ মে) ৯৮ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। ডলারের পাশাপাশি বর্তমানে ইউরো বিক্রি হচ্ছে ১০৪ টাকায়, যা আগে ছিল ১০২ টাকা। পাউন্ড বিক্রি হচ্ছে ১২৪ টাকায়। এর ফলে বিদেশগামী যাত্রী, রোগী ও পর্যটকদের খরচ বেড়ে গেছে।

এছাড়া, দুবাইয়ের মুদ্রা দিরহামের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রতি দিরহামের দাম ২৭ টাকার ওপরে, যা এক মাস আগেও ছিল ২৪ টাকা। আগামী ৩১ মে হজ শুরু হচ্ছে। এতে বেড়ে গেছে সৌদি মুদ্রা রিয়ালের দাম। ফলে এখন প্রতি রিয়াল কিনতে হচ্ছে ২৬ টাকায়। শুধু খোলাবাজারেই নয়, ব্যাংকগুলোতেও নগদ বিক্রিতে এসব মুদ্রার দাম বেড়ে গেছে।

ডলার সংকট কাটাতে করণীয় নির্ধারণে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে সভায় বসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রপ্তানি বিল নগদায়ন ও প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে ডলারের দামের সীমা বেঁধে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।

এদিকে ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য ১০-১২ টাকা। এতে অবৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। কারণ, ডলারের দামের পার্থক্য আগে কখনো এত বেশি হয়নি। তাই ব্যাংকাররা ডলারের সর্বোচ্চ দাম নির্দিষ্ট করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করে দিলেও রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৫০ পয়সা, পাউন্ড ১২৩ টাকা ৫০ পয়সা, ইউরো ১০৩ টাকা ৫০ পয়সা, সিঙ্গাপুরের ডলার ৬৯ টাকা, ভারতীয় রুপি ১ টাকা ২৬ পয়সা, সৌদি রিয়াল ২৫ টাকা ২০ পয়সা, দুবাইয়ের দিরহাম ২৬ টাকা ২০ পয়সা দরে বিক্রি করেছে।

বেসরকারি খাতের ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) নগদে প্রতি ডলার ৯৭ টাকা, ইউরো ১০৪ টাকা ৩৮ পয়সা ও পাউন্ড ১২২ টাকা ৭৯ পয়সায় বিক্রি করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গতকাল প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা। তবে ব্যাংকগুলো ৯৫ টাকা দরে প্রবাসী আয় আনছে ও রপ্তানি বিল নগদায়ন করছে। এর চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। ফলে আমদানি পণ্যের দাম ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে দীর্ঘসময় মানুষ দেশের বাইরে যাননি। ফলে এখন করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় অনেক মানুষ চিকিৎসার প্রয়োজনে বা ঘুরতে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। আবার, আগামী মাসেই হজগামী যাত্রীরা সৌদি আরব যাবেন। ফলে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়েছে। সেই অনুপাতে সরবরাহ কম থাকায় ডলারের দামও অনেক বেশি বেড়ে গেছে। তাদের মতে, যিনি যে দেশে যাচ্ছেন, তার জন্য সেই দেশের মুদ্রা সহজলভ্য করা হলে তা ডলারের ওপর চাপ কমাতে পারে।

এদিন মতিঝিলে ডলার কিনতে আসা সোহেল হাসান বলেন, আমার বাবা চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে যাবেন। সেজন্য প্রয়োজনীয় ডলার কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু ডলারের দাম অনেক বেশি হওয়ায় যতটুকু কিনতে চেয়েছিলাম তার থেকে কম কিনতে হয়েছে। এতে চিকিৎসার ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ডলারের দাম কমানোর অনুরোধ জানান তিনি।

মানি চেঞ্জার ও খোলাবাজারের মুদ্রা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে অনেক বেশি সংখ্যাক মানুষ দেশের বাইরে ঘুরতে বা চিকিৎসার কাজে যাচ্ছেন। ফলে ডলারের চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই তুলনায় ডলারের সরবরাহ অনেক কম।

তাদের মতে, সাধারণত বিদেশ থেকে যারা আসেন, তারা সঙ্গে করে ডলার নিয়ে আসেন। নগদ ডলারের যোগানের এটাই একমাত্র মাধ্যম। আর দেশের মানুষের হাতে যা থাকে, তা অনেক সময় বিক্রি করেন। এ ছাড়া বিদেশি পর্যটকেরা ডলার বিক্রি করে টাকা নেন। কিন্তু এখন ডলার বিক্রি করতে খুব বেশি গ্রাহক আসেন না। ব্যবসায়ীরা নিজেদের হাতে থাকা ডলার বিক্রি করছেন। অর্থাৎ খোলাবাজারে চাহিদার তুলনায় যোগান কম হওয়ায় ডলারের দাম বাড়ছে।

জানতে চাইলে যমুনা মানি চেঞ্জারের স্বত্তাধিকারী আনিসুজ্জামান অর্থসূচককে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের দাম বেশি। এর কারণ হচ্ছে বাজারে ডলারের সরবরাহ অনেক কম। কিন্তু সেই তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। এ কারণেই দাম বেড়ে গেছে। আর ডলারের দাম বাড়ায় এখন অন্য মুদ্রাগুলোর ওপর চাপ বেড়ে গেছে। অনেকে যে দেশে যাচ্ছেন, সেই দেশের মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাজারে সেভাবে বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ নেই। এ জন্য দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ডলারের সরবরাহ না বাড়লে এই সংকট সহসা কাটবে বলে মনে হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে, ব্যাংক খাতে ডলারের সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৩ মে পর্যন্ত ৫৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক এখন তেল, গ্যাস, সারসহ সরকারি আমদানির পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্য আমদানিতেও ডলার সরবরাহ করছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক গাড়িসহ কিছু বিলাসপণ্য আমদানিতে ৭০ শতাংশ নগদ জমার বাধ্যবাধকতা দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০০টিরও বেশি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছে।

 

অর্থসূচক/ মৃত্তিকা সাহা

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.