পতন ঝড়ে বেক্সিমকোও নড়বড়ে

দেশের পুঁজিবাজারে দর পতনের যে ঝড় চলছে তাতে ছোট-বড় সব কোম্পানিই কাবু। স্থানীয় বা বহুজাতিক- কোনো কোম্পানির শেয়ারই এ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। এই ঝড়ে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক শক্তিশালী ভিতের কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত বেক্সিমকো’র অবস্থাও অনেকটা বড়বড়ে হয়ে পড়েছে। গত ছয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম প্রায় ২৭ শতাংশ কমেছে।

বাজারমূলধনে অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি বেক্সিমকোর শেয়ারের দাম বাড়লে বা কমলে মূল্যসূচকের উপর অনেক বেশি প্রভাব পড়ে। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারের দাম কমেছে ২ টাকা ৮০ পয়সা। তাতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৩ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট। সপ্তাহভর সূচক হ্রাসে দায়ী প্রধান ৫টি কোম্পানির ২টি ছিল বেক্সিমকো।

বেক্সিমকোর পূর্ণ নাম- বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি। এটি বেক্সিমকো গ্রপের ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকার বাইরে থাকা বেশ কিছু কোম্পানি বিভিন্ন সময়ে বেক্সিমকোর সাথে একীভূত হয়েছে।

করোনাভাইরাস অতিমারির মধ্যে ২০২০ সালের শেষভাগ থেকে ২০২১ সালের শেষভাগ পর্যন্ত দেশের পুঁজিবাজারে যে ধারাবাহিক উর্ধগতি দেখা গেছে, তার নেতৃত্ব দিয়েছে বেক্সিমকো। অনেকটা বেক্সিমকোর শেয়ারের উপর ভিত্তি করেই বেড়েছে সূচক। বেক্সিমকোর শেয়ারের দাম যেদিন বেড়েছে, সেদিন বাজারে সূচকও বেড়েছে। আবার বেক্সিমকোর শেয়ারের দাম কমলে তার প্রভাবে কমেছে সূচক। বেক্সিমকোর শেয়ারের দাম টানা বাড়তে থাকায় তা বাজারে এক ধরনের প্রাণের সঞ্চার করে। আলোড়ন তৈরি হয়। বাজারের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আস্থা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে এক সময় অন্যান্য কোম্পানির শেয়ারের দামও উর্ধমুখী হয়ে উঠে। এক বছরের মধ্যে শেয়ারটির দাম ৮০০ শতাংশ বেড়ে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে বেক্সিমকোর শেয়ারের দাম। অন্যদিকে সামগ্রিক বাজারেও শুরু হয় মূল্য সংশোধন বা পতন।

পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বেক্সিমকোর শেয়ারের দাম ছিল ২৪ টাকা ৪০ পয়সা। সেখান থেকে দ্রুত উর্ধগামী হতে থাকে শেয়ারের দাম। ঠিক এক বছরের মাথায় কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়াঁ ১৮৫ টাকা। এক বছরের মধ্যে শেয়ারটির দাম বাড়ে ৬৫৮ শতাংশ। এত অল্প সময়ে একটি শেয়ারের এমন মূল্যবৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের যে কোনো পুঁজিবাজারেই বিরল।

মূল্য বৃদ্ধির উর্ধগতির সময়ে বেক্সিমকো দেশে সুকুক ছেড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের ঘোষণা দেয়। দেশে সুকুক নামের ইসলামী বন্ড ছেড়ে টাকা উত্তোলনের ঘটনা এটিই প্রথম।

২০২১ সালের ৩ মার্চ সুকুক ইস্যুর ঘোষণা দেয় বেক্সিমকো। সেদিন ডিএসইতে শেয়ারটির দাম ছিল ৮৫ টাকা ৪০ পয়সা। ঘোষণায় বলা হয়, আলোচিত সুকুক হবে শেয়ারে রূপান্তরযোগ্য (Convertible), অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সুকুকের একটি অংশ বেক্সিমকোর সাধারণ শেয়ারে রূপান্তরিত হবে। বন্ডের টাকা বিনিয়োগ করা হবে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে। এ ঘোষণার পর কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধির পালে নতুন বাতাস লাগে। তবে সুককের অর্থ উত্তোলনের পর থেকেই কোম্পানিটির  শেয়ারের দাম পড়তে থাকে। সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতিতে পতনের তীব্রতা বেড়ে যায়।

বিশ্লেষকদের মতে, বেক্সিমকোর শেয়ারের উত্থানের মধ্যেই এর পতন লুকিয়ে ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে এতটা মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবে স্বাভাবিকতার মধ্যে থাকে না। আর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হলে বড় রকমের মূল্য সংশোধন অনিবার্য হয়ে উঠে।

তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, কোম্পানিটির ইতিহাসের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্সের সময়ে শেয়ারটির দাম না বেড়ে উল্টো কমে যাচ্ছে। গত ২৮ এপ্রিল বেক্সিমকো সর্বশেষ প্রান্তিকের (জানুয়ারি’২২-মার্চ’২২) আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দেখানো হয় ৪ টাকা ৫১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৯০ শতাংশ বেশি। আগের বছর তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছিল ২ টাকা ৩৮ পয়সা। চলতি বছরে তিন প্রান্তিক মিলিয়ে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ১৩ টাকা ১৮ পয়সা, যা আগের বছর একই সময়ে ৪ টাকা ৩০ পয়সা ছিল। তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটির ইপিএসের প্রবৃদ্ধির হার ২০৭ শতাংশ। এত ঝলমলে পারফরম্যান্সের খবরে পরের দিন শেয়ারটির দাম কমে যায়। তারপর থেকে অনেকটা বিরতিহীনভাবে শেয়ারের মূল্যপতন চলছেই।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.