রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতিতে দেশ

করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই আমদানিতে জোয়ার বইছে। রফতানি আয় বাড়লেও সেই তুলনায় বাড়ছে না। এতে রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি (আমদানি ও রফতানির মধ্যে ব্যবধান) তৈরি হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের ৯ মাসেই (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন (২ হাজার ৪৯০ কোটি ৭০ লাখ) ডলার। যা গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬৪ শতাংশ বেশি। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়েও ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি।

২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ২২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এত বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েনি দেশ। বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির ফলে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।

অর্থনীতিবিদদের মতে, পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ও লেনদেন ভারসাম্যে বড় অঙ্কেও ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমদানির লাগাম টেনে ধরা। যে করেই হোক এটা করতে হবে। তা না হলে সংকটে পড়বে অর্থনীতি।

এই প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘লাগামহীন আমদানিতে বেশ চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। ব্যালান্স অফ পেমেন্ট ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার।
তিনি বলেন, এখন যে করেই হোক আমদানি কমাতেই হবে। এছাড়া আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণভাবে অর্থনীতিতে আমদানি বাড়াকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়ে থাকে। কেননা আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। এতদিন আমরাও সেটা বলে আসছি। কিন্তু এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ৫০ শতাংশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা আমাদের অর্থনীতির নেই। এখন এটা কমাতেই হবে। তা না হলে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়বে দেশের অর্থনীতি।’

বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ৪০ লাখ (৬১.৫২ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ৪২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।

অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে ৩৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রফতানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি।

এ হিসাবেই অর্থবছরের ৯ মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।

জুলাই-মার্চ সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ১৯৯ কোটি ২০ লাখ ডলার।

মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

একইভাবে, লেনদেন ভারসাম্যেও বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছর শুরুই হয়েছিল লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়ে। দিন যত যাচ্ছে, ঘাটতি ততই বাড়ছে। প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৩১ কোটি ৪০ লাখ (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার। চার মাস শেষে (জুলাই-অক্টোবর) তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৬ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে ঘাটতি ছিল ৬ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বর শেষে তা আরও বেড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। জানুয়ারি শেষে ১০ দশমিক শূন্য ১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।

ফেব্রুয়ারি শেষে তা ১২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। সবশেষ মার্চ শেষে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলারের চূড়ায় উঠেছে। এর আগে কোনো অর্থবছরেও এত বিশাল ঘাটতিতে পড়েনি বাংলাদেশ।

করোনা মহামারির কারণে আমদানি কমায় ৯২৭ কোটি ৪০ লাখ (৯.২৭ বিলিয়ন) ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের বছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

বাণিজ্য এবং লেনদেনে ঘাটতি বাড়লেও আর্থিক হিসাবে এখনও বড় ধরনের উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-মার্চ সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের এই সময়ে ৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।

করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণসহায়তা পাওয়ায় আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.