‘মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন’

মেঘনা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক। রয়েছে আরও কয়েকটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে উচ্চ পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমিতে চিফ অ্যাকাউন্টেড হিসেবে কাজ করেছেন ১০ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে অনার্স এবং মাস্টার্সে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। সব মিলিয়ে এই খাতে দীর্ঘ প্রায় ৩৩ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কাজ করছেন। বীমা খাতের বর্তমান অবস্থা, পুঁজিবাজারে বীমা খাতের অংশগ্রহণসহ এই খাতের সংকট এবং উত্তরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অর্থসূচকের সাথে কথা বলেছেন। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার মৃত্তিকা সাহা

অর্থসূচক: করোনা ভাইরাস অতিমারি ব্যবসা-বাণিজ্যের সকল খাতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বীমাখাতে এই প্রভাব কতটুকু পড়েছে?

আবু বকর সিদ্দিক: অর্থনীতির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে বীমা খাত। ফলে অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে, তা বীমাখাতেও পড়েছে। কেননা অর্থনীতির উন্নয়নের সাথে সাথে যেমন বীমা খাতের উন্নয়ন হয়, তেমনি অর্থনৈতিক মন্দা হলে বীমা খাতেও মন্দা দেখা দেয়। বীমা মূলত মানুষের আর্থিক ঝুঁকি নিরাপত্তা হিসেবে কাজ করে। আর্থিক লেনদেন, আর্থিক বিষয়াদি উন্নয়নের সাথে বীমা খাত জড়িত। একটা শিল্পায়ন হলে, কারখানা হলে বীমা করতে হবে। কারখানার যন্ত্রপাতি কিনতে হলে বীমা করতে হয়। কাজেই এগুলো যদি বন্ধ থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বীমা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে করোনা অতিমারীর সময়েও চলমান অর্থনৈতিক কর্মকা- কিন্তু থেমে নেই। সেগুলো কিন্তু বীমা কাভারেজের আওতার মধ্যেই আছে। ফলে নতুন নতুন শিল্পায়ন এবং আমদানি-রফতানি খাতে নতুন বীমা কাভারেজ না হলেও বীমা খাত চলতি অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্থিতিশীল রয়েছে। ফলে বীমা খাতে করোনার ক্ষতিকর প্রভাব পড়লেও খুব বেশি না। আংশিক প্রভাব পড়েছে।

অর্থসূচক: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ববাণিজ্যের উপর বেশ প্রভাব ফেলছে। আমাদের বীমা খাতে কী এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা আছে?

আবু বকর সিদ্দিক: আশংকা তো থাকবেই। কারণ বীমা ব্যবসাটাই হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। ধরেন, বাংলাদেশে বীমা করেছে বড় একটা শিল্প প্রতিষ্ঠানে। সেই প্রতিষ্ঠানের বীমাটা পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাচ্ছে রি-ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের কোথাও যদি যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়, তার প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতি তথা বীমা খাতেও। কেননা বিশ্ব অর্থনীতির সাথে বীমা অর্থনীতিও জড়িত। আর এই যুদ্ধ যদি আরো ছড়িয়ে পড়ে তাহলে আরো বেশি প্রভাব পড়বে। এছাড়া, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যদি ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অর্থনীতির সূচকগুলোতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। এক্ষেত্রে বীমা খাতেও বিরূপ প্রভাব পড়বে।

অর্থসূচক: নানা সমস্যার মধ্যেও সর্বশেষ হিসাববছরে বেশিরভাগ বীমা কোম্পানির আয় বেড়েছে। এই ধারা সাসটেইনেবল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?

আবু বকর সিদ্দিক: করোনা মহামারির প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতির সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসছে। আর বীমা খাতে যেহেতু এর প্রভাব সামান্য। তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে বীমা খাতও এগিয়ে যাচ্ছে। অতিমারীর সময়েও বীমা কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করতে পেরেছে। পরিসংখ্যানেও সেই তথ্য উঠে এসেছে। ফলে সর্বশেষ হিসাব বছরে বেশির ভাগ বীমা কোম্পানির আয় বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সময়ে বীমা খাতে আয় বাড়ার পাশাপাশি প্রসারও বেশ ভালো হয়েছে। সেই বিবেচনায় বলা যায়, এটা অবশ্যই সাসটেইনেবল হবে। কেননা যুদ্ধকালীন সময়ে যদি খাদ্যের সংকট না হয় তাহলে অন্য কোন কিছুর সংকট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কাজেই আমি মনে করছি এটা সাসটেইনেবল থাকবে।

অর্থসূচক: সামগ্রিকভাবে দেশের বীমা খাতের অবস্থা কী? এই খাতের উন্নয়নে আর কী করণীয় আছে?

আবু বকর সিদ্দিক: সামগ্রিকভাবে দেশের বীমা খাত মোটামুটিভাবে ভালো আছে। তবে এই খাতের উন্নয়নে আরো অনেক কিছু করার আছে। সেগুলো করা হলে এই খাত থেকে সরকার আরো বেশি লাভবান হতে পারে। এবং জিডিপিতে এর অংশগ্রহণও আরো বেশি বাড়তে পারে। অর্থাৎ জিডিপিতে বীমা খাতের যে অবদান সেইটা আরো বাড়ানো যায়।

তবে বর্তমানে বীমা খাত খুব যে পরিশীলিত বা পরিমার্জিতভাবে চলছে, সেটা বলা যাবে না। এই খাতে যে অনৈতিক অবস্থা, অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি রয়েছে তা দূর করতে হবে। এখনো এই খাতে বিভিন্ন রকম অনিয়ম, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও অনৈতিক ব্যবস্থা চলছে। এগুলো দূর করতে হলে এই খাতের প্রতি সরকারকে আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে। বীমা কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করতে হবে।

বীমা খাতে এখনো সঠিক নিয়মে বীমা করা হয় না। অর্থাৎ প্রপার্টি ভ্যালু অনুযায়ী বীমা করা হয় না। প্রপার্টি যে ভ্যালু দেয়, সেটাকে সঠিক ধরে নিয়ে যদি বীমা করা হয়, তাহলে প্রিমিয়াম বাড়বে। বীমা খাতে যদি সুস্থ প্রতিযোগিতা হতো, তাহলে বীমা খাত আরো বেশি সমৃদ্ধ হতো।

অর্থসূচক: বীমা খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতা না হওয়ার পেছনে কারণ কী বলে মনে করেন?

আবু বকর সিদ্দিক: একই ব্যবসার পেছনে আমরা অনেকেই ছুটছি। তবে সবাই কিন্তু একই লেবেল থেকে ছুটছি না। রাজনীতিতে যে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলা হয়, এখানেও একই কথা প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ আমরা সবাই কিন্তু লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডে নাই। কারণ পরপর চারটা প্রজন্মে বীমা কোম্পানিগুলো আসছে। প্রথম প্রজন্মেও বীমা কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দ্বিতীয় প্রজন্মেও গুলো সেই পরিমাণে হয়নি। তৃতীয় প্রজন্মে আরো কম আর চতুর্থ প্রজন্মেরগুলো আরো কম। যেহেতু বীমা কোম্পানিগুলো সম অবস্থানে নেই, সেহেতু সবাই একইভাবে বীমা গ্রাহকের বিশ^স্ততা অর্জন করতে পারছে না। সেইসাথে তাদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। এক্ষেত্রে যারা একটু কম প্রতিষ্ঠিত তারা বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে চাই। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীগুলো কম সুবিধা দিলেও গ্রাহক তাদের উপর বেশি আস্থা রাখে। ফলে তারা বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সাথে সহজে চুক্তিবদ্ধ হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীগুলো যেভাবে ব্যবসা করতে পাওে ছোট কোম্পানীগুলো সেভাবে পারে না। ছোট কোম্পানীগুলো প্রদর্শন করার মতো অ্যাসেটও কম। যা দেখিয়ে বীমা গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে পারেন। ফলে তাদেরকে বীমা গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে হলে বেশি উপঢৌকন দিতে হয়। বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়। আর এটাই হচ্ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এটাকে খাটি বাংলায় বলা হয় কমিশন বাণিজ্য। এই বাড়তি বা কমতি কমিশন ব্যবস্থা যদি প্রতিরোধ করা যেতো, তাহলে বীমা কোম্পানীগুলো লাভবান হতো। সরকারও লাভবান হতো। কোন কোম্পানির মুনাফা বেশি হলে সরকারও সেখান থেকে বেশি কর আদায় করতে পারে।

অর্থসূচক: বীমা খাতের আরও উন্নয়নে করণীয় কী?

আবু বকর সিদ্দিক: বীমা খাত বিষয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে আরো বেশি সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যদিও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এরই মাঝে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা যথাযথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে তাদের লোকবলের অভাবে আরো শক্তিশালী মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণ করতে পারছে না। কেননা একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বীমা কোম্পানীগুলোকে সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য ঘন ঘন অডিটিং ও মনিটরিং দরকার। সেগুলো হয়তো বীমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ করতে পারছে না।

আমাদের দেশে ব্যাংকগুলো সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য বিশাল নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আকার আয়তন এবং দক্ষ জনবল সবদিক থেকেই পরিপূর্ণ। অন্যদিকে বর্তমানে দেশে লাইফ এবং নন লাইফ মিলে প্রায় ৮০ টা বীমা কোম্পানী রয়েছে। যা ব্যাংকের চেয়েও বেশি। কিন্তু এসব কোম্পানীকে মটিটরিং করার জন্য ছোট্ট একটা বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ম থেকেই দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। এটা একটা বিশাল খাত। এই খাতকে সুচারুভাবে মনিটরিং করার জন্য এখানে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। বীমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। বীমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যতো বেশি শক্তিশালী হবে, বীমা কোম্পানীগুলোও ততো বেশি গতিতে কাজ করবে। ফলে সার্বিকভাবে এই খাতের উন্নয়ন হবে। এবং সরকার এই খাত থেকে লাভবান হবে।

তিনি বলেন, বীমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মর্কাদের ডেপুটেশনে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে তারা অনেক জ্ঞানী হন, কিন্তু সেটা বীমা খাতে নয়। তখন দেখা যায়, বছরখানেক তারা বীমা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন কওে যখনই সেটা কাজে প্রয়োগ করতে যান, তখনই তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে হাওলাতি বা খয়রাতি লোক দিয়ে তো কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থা চলতে পাওে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে শক্তিশালী হতে হলে বেশি পরিমাণে নিজস্ব এবং দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে।

অর্থসূচক: আমাদের দেশে বীমা বিষয়ে অধিকাংশ গ্রাহকের অনীহা দেখা যায়। এর কারণ কী?

আবু বকর সিদ্দিক: বীমা গ্রাহকরাও বীমা বিষয়ে সচেতন নয়। তারা একরকম বাধ্য হয়ে বীমা করে। কিন্তু বীমার গুরুত্ব তেমনভাবে অনুধাবন করেন না। বিপদে পড়ে যখন বীমা দ্বারা উপকৃত হন, তখনই এর গুরুত্ব অনুধাবন করেন। আমাদের দেশের গ্রাহকরা যদি বীমা বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হতো তাহলে বীমা শিল্পও আরো বেশি এগিয়ে যেতো। আমাদের দেশের বীমা গ্রাহকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নগদায়নে বিশ্বাসী। যেহেতু বীমা একটা কমিটমেন্টের ব্যবসা। অর্থাৎ আজকে একজন গ্রাহক বীমা করলে ভবিষ্যতে কোন দুর্ঘটনায় পড়লে তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন। এই কমিটমেন্টের জায়গায় গ্রাহককে শতভাগ আস্থা অর্জনের জায়গায় নিতে পারে নি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো। বীমা দাবী দিতে এবং পেতে দেরি হয় বলেই আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষই দায়ী। তবে এক্ষেত্রেও পরিবর্তন হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশীয় কোম্পানীগুলোও সময়মতো বীমা দাবি পরিশোধ করছে। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষও এদিকে দৃষ্টি রাখছে। বীমা দাবিগুলো পরিশোধ হচ্ছে বলে গ্রাহকের আস্থাও দিনে দিনে বাড়ছে। এই কারণেই আমরা অতিমারিতেও সাসটেইনেবল ব্যবসা করতে পারছি।

অর্থসূচক: বীমা খাতের উন্নয়নে কোন প্রতিবন্ধকতা আছে কী?

আবু বকর সিদ্দিক: আমাদের বীমা পেশাজীবীদের মধ্যে ঐক্যের অভাব আছে। একই পণ্য নিয়ে অন্যান্য ব্যবসার ক্ষেত্রে দেখা যায়, সিন্ডিকেট তৈরি হয়ে যায়। আর আমাদেও ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট তো দূরের কথা, ন্যূনতম ঐক্যও তৈরি হয় না। আমরা ব্যবসা করার ক্ষেত্রে পারলে সবকিছু দিয়ে ব্যবসা আনতে চাই। এর কারণ হচ্ছে আমরা যারা বীমা পেশায় কাজ করছি অধিকাংশেরই পেশাগত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আমরা মনে করি বীমা ব্যবসা করতে হবে, তাই করছি। কিন্তু এই ব্যবসার পেছনে লাভ হচ্ছে না লস হচ্ছে সেটা আমরা বিবেচনা করছি না। সবকিছু দিয়ে হলেও আমাদের ব্যবসাটা করতে হবে। কিন্তু এই জিনিসটা আমরা ভুলে যাই যে, বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে ব্যবসা কেনার সময় লাভ করতে না পারলে বিক্রি করার সময় লাভ করা যাবে না।

অর্থসূচক: এই প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে আপনার পরামর্শ কী?

আবু বকর সিদ্দিক: আমাদের মধ্যকার ঐক্যের অভাব দূর করতে ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন মাঝে মাঝে কিছু পদক্ষেপ নেন। এসব পদক্ষেপ কিছুদিন চললেও খুব বেশি টেকসই হয় না। যেমন- একজনের ব্যবসা যেন অন্যজন না দিনতে পারেন, সেজন্য আমরা জেন্টেলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট করলাম। কিন্তু মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে তো এমনটা করার সুযোগ নাই। আইনগতভাবেও এটা শক্তিশালী না। এখানে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মালিকদের মধ্যেও কারা শক্তিশালী, কারা দুর্বল সেটাও বিবেচনা করা হয়। শক্তিশালী মালিকপক্ষের ছত্রছায়ায় যেসব কোম্পানি আছে, সেগুলো অনেক সময় রুলস, রেগুলেশন মানতে চায় না। অনেক সময় কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে অসহায় হয়ে যায়।

অর্থসূচক: মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে আপনার কোম্পানির পারফরম্যান্সকে কী মূল্যায়ন করেন?

আবু বকর সিদ্দিক: মেঘনা ইন্স্যুরেন্সে কাজ করে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের যে পারফরম্যান্স আছে আমি সেটাতে সন্তুষ্ট। আমি আশা করবো, অদূর ভবিষ্যতে আরো ভালো করবে এই প্রতিষ্ঠান। আমরা ভালো করছি বলেই এই অবস্থায়ও পুঁজিবাজাওে আসতে পারছি। অতি মহামারিতে আমরা ভালো ব্যবসা করেছি। আমাদের এই কোম্পানী যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। আসলে বীমা ব্যবসাটা হলো মানবসম্পদ নির্ভরশীল ব্যবসা। যেটাকে সাধারণ মানুষ অনেক সময় বলে কাগজ বিক্রির ব্যবসা।কাগজের মধ্যে আমরা যে কমিটমেন্টটা বিক্রি করি, সেই কাজটা যারা করবে, তাদের ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা, সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করেই তারা কাজটা করে থাকে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে যারা বীমা ব্যবসা প্রকিউরমেন্টের সাথে জড়িত, তারা মোটামুটিভাবে চৌকস, অত্যন্ত জ্ঞানী, বিচক্ষণ এবং অভিজ্ঞ। সেই কারণেই আমরা ক্রমান্বয়ে ভালো করছি। আমাদের কোম্পানীতে বীমা দাবি নিয়ে তেমন কোন জটিলতা নাই। কোন মামলা-মোকদ্দমাও নাই। আমাদের গ্রাহকরাও এই বিষয়ে যথেষ্ট সন্তুষ্ট। আমরা বীমা ব্যবসার মূল যে প্রতিপাদ্য বিষয় (বীমা দাবি পরিশোধ করা। অর্থাৎ ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা) সেটাকে সামনে রেখেই এগিয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ আমরা বীমা করছি। যারা ক্ষতিপূরণ দাবি করছে, আমরা সেটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করছি। ফলে গ্রাহকের মধ্যে আমাদেও প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাও বাড়ছে। এর প্রভাবে আমাদের ব্যবসাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অর্থসূচক: আপনাদের প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে তাতে মেঘনা ইন্স্যুরেন্স এবং বাজারের বিনিয়োগকারীরা ও স্টেকহোল্ডাররা কতটুকু লাভবান হবে বলে আশা করেন?

আবু বকর সিদ্দিক: খুব শিগগিরই আমাদের প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভ’ক্ত হতে যাচ্ছে। এতে যারা আমাদের প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার হবেন, বা যারা শেয়ার কিনবেন, তারা অবশ্যই লাভবান হবেন। কেননা আমাদের কোম্পানি উত্তরোত্তর উন্নতি করছে। আমাদের ব্যবসা বেশি হচ্ছে, ফলে আমাদের মুনাফাও বেশি হবে। আর মুনাফা বেশি হলে শেয়ারহোল্ডাররাও লাভবান হবেন।

অর্থসূচক: আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ১৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে মেঘনা ইন্স্যুরেন্স। এই অর্থ বিনিয়োগে কতটুকু লাভবান হবে এই কোম্পানি?

আবু বকর সিদ্দিক: পুঁজিবাজার থেকে যে ১৬ কোটি টাকা উত্তোলনের লক্ষ্য আমরা ঠিক করেছি, সেটা আমরা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অথবা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবো। সরকারি যেসব নিয়ম-নীতি আছে সেগুলো মেনেই আমরা বিনিয়োগ করবো। এতে আমরা অবশ্যই কিছুটা লাভবান হবো।

অর্থসূচক: আইপিওকে সামনে রেখে বিনিয়োগকারী ও স্টেকহোল্ডারদের উদ্দেশ্যে আপনার ম্যাসেজ কী?

আবু বকর সিদ্দিক: আমাদের প্রতিষ্ঠান সব ধরনের বিধি-বিধান এবং বীমা আইন মেনে ব্যবসা করছে। আমাদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হচ্ছে। ফলে আমরা আশাবাদী এখানে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবে। বীমা পলিসি করার সময় আমরা দেখে-শুনে পলিসি করি, আমাদের প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদও অনেক বেশি শক্তিশালী। আমাদের মালিকপক্ষও অনেক বেশি সহযোগিতাশীল। মালিকপক্ষের কোন অনৈতিক দাবি দাওয়া বা চাহিদা নাই। অনেতিক কোন হস্তক্ষেপ করেন না। যার ফলে এই প্রতিষ্ঠান অদূর ভবিষ্যতে আরো ভালো করবে।

অর্থসূচক: অন্যান্য কোম্পানিগুলোর সাথে আপনাদের পার্থক্য করা যায়, এমন কোন পণ্য আছে কী?

আবু বকর সিদ্দিক: তেমন কোন ভিন্ন পণ্য আমাদের নাই। সাধারণভাবে বাজারে যে পণ্যগুলো চালু আছে বা বীমা গ্রাহকরা যেসব পলিসিগুলো চায়, সেগুলোর মাধ্যমেই আমরা তাদের সেবা দিয়ে থাকি। যে দেশে বীমা সচেতনতা বা আস্থা খুব বেশি নাই, সেখানে নতুন নতুন পণ্য চালু করা খুবই কঠিন। ফলে যেগুলো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সেগুলোই আমরা দিচ্ছি। বীমা কোম্পানি তখনই এগিয়ে যাবে, যখন বীমার যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ গ্রাহকরা যে উদ্দেশ্যে বীমা করে, সেটা যদি সঠিকভাবে পায় তাহলে বীমা গ্রাহকরা আকৃষ্ট থাকবে। সেই সাথে কোম্পানিও লাভবান হবে।

অর্থসূচক: বিশ্বের অন্যান্য দেশে বীমা খাত অনেক বেশি শক্তিশালী। সেই তুলনায় আমাদের দেশে বীমা খাত এখনো অনেক পিছিয়ে। এর কারণ কী?

আবু বকর সিদ্দিক: যে দেশে অর্থনৈতিকভাবে যত বেশি শক্তিশালী, সেই দেশে বীমা খাতও অত্যন্ত শক্তিশালী। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বীমা ছাড়া মানুষ এক পাও বের হয় না। আর আমাদেও সমাজের বৃহদাংশেরই এখনো নুন আনতে পানতা ফুরায়। আর যাদের আয় ভালো, তাদেও ব্যয়ও ভালো। একজন মানুষ তখনই বীমা কওে যখন তার সব প্রয়োজন মিটে যায়। মানুষের মৌলিক চাহিদা ( অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা) পূরণ হওয়ার পরেই ষষ্ট নাম্বারে মানুষ বীমা করার চিন্তা করে থাকে। যদিও আমাদের দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী বীমা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, আমাদের দেশে এখনো একজন বা দুজন সদস্যের উপর পুরো পরিবারের ব্যয় নির্ভর করে। ফলে সেই উপার্জনক্ষম মানুষটির যদি বীমা করা থাকে তাহলে তার অবর্তমানে সেই পরিবারকে আর্থিক স্বচ্ছলতার কিছুটা হলেও নিশ্চয়তা দিতে পারে তার বীমা প্রতিষ্ঠান। যেমন জীবন বীমার মাধ্যমে আমরা জীবনের নিশ্চয়তা দেই না। আমরা দেই জীবনের আর্থিক নিশ্চয়তা। আবার সম্পদ বীমার মাধ্যমে সম্পদের যে আর্থিক ক্ষতি হবে , সেটা বীমা প্রতিষ্ঠান তার বীমা গ্রাহককে দিবে।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.