ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: বুচা শহরে হাত-বাঁধা লাশের সারি

কিয়েভকে অবরুদ্ধ করে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারকে উৎখাতের যে স্বপ্ন রাশিয়া দেখছিল তার প্রথম কবর রচিত হয়েছে ইউক্রেনের শহর বুচার একটি সরু রাস্তায়। সেই সময়টি আসে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে কিয়েভের কাছে বুচা নামের ঐ শহরে পৌঁছে গিয়েছিল রুশ বাহিনী। সেখানে রাশিয়ার একটি ট্যাংক ও সাঁজোয়া বহর ইউক্রেনীয় বাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। খবর- বিবিসির

ইউক্রেনীয় বাহিনীর এরকম আরও অনেক প্রতিরোধ হামলায় রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা থমকে যায়। পাঁচ সপ্তাহ তুমুল লড়াইয়ের পর ঐ এলাকা থেকে সরে যায় রুশ বাহিনী। রুশ সৈন্যদের শেষ দলটি গত শুক্রবার বুচা থেকে সরে যাওয়ার পর সাংবাদিকদের একটি দল সেখানে যায়। কিন্তু আগ্রাসন শুরুর দু’ থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুশ বাহিনী কেন গতি হারিয়েছিল, তার একটা ধারণা পাওয়া যায় ঐ শহরের রাস্তার পরিস্থিতি দেখে।

প্রমাণ বা নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য ছাড়াই রাশিয়া বলেছিল, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের দিকে মনোযোগ বাড়ানোর জন্যই তারা কিয়েভ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। মধ্য ইউক্রেইনে তাদের বাহিনীর যে লক্ষ্য ছিল, তা ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে। আসলে কিয়েভ দখলের কোনো পরিকল্পনাই তাদের ছিল না।

কিন্তু আসল সত্যটা হলো, ইউক্রেনীয় বাহিনীর অপ্রত্যাশিত প্রবল ও সুসংগঠিত প্রতিরোধই রুশ বাহিনীকে কিয়েভের বাইরে ঠেকিয়ে দিয়েছে। বুচার রাস্তায় আগুনে পোড়া ও গলে যাওয়া দীর্ঘ সামরিক বহরই তার প্রমাণ। যুদ্ধের দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুশ বাহিনীর দম বেরিয়ে গেয়েছিল। বিমানে চড়িয়ে আনা যায় এমন হালকা সাঁজোয়া যানে চেপে রুশ এলিট সেনারা বুচায় ঢুকেছিল।

তারা এসেছিল কয়েক মাইল দূরের বিমানবন্দর হস্টোমেল থেকে। আগ্রাসনের শুরুর দিকেই হেলিকপ্টারে নামা রুশ সেনারা ঐ বিমানবন্দরটিকে দখল করেছিল। কিন্তু তার পর থেকেই তাদেরকে প্রতিনিয়ত ইউক্রেনীয় বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিয়েভের পথে রুশ সামরিক বহরটি বুচার দিকে অগ্রসর হওয়ার পরই কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। শহরটিতে ঢোকার রাস্তাটি ছিল সোজা ও সরু – অ্যামুবশ করার জন্য যা ছিল উপযুক্ত।

রুশ বহরের ওপর ইউক্রেনীয় বাহিনী তুরস্ক থেকে আনা বেরাকতার অ্যাটাক ড্রোন দিয়ে হামলা চালায় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ইউক্রেনের স্বেচ্ছাসেবক প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও সে সময় ঐ এলাকায় তৎপর ছিল। তারা যেটা করেছিল তা হলো রুশ বহরের সামনের এবং পেছনের যানগুলোকে ধ্বংস করে তারা বহরটিকে দু’দিক থেকে আটকে দিয়েছিল।

বুচার স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ বাহিনীর হামলায় রুশ বহরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, অনেককে আটকও করা হয়। রুশ বাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগ পাওয়া তরুণ সেনারা এসব হামলায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে প্রাণ-ভিক্ষা চায় এবং তাদেরকে ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর হাতে তুলে না দেয়ার অনুরোধ জানায়।

`তাদের জন্য আমার বেশ কষ্ট হয়েছিল। এত কম বয়সী ছিল তারা, – ১৮ থেকে ২০ – তাদের সামনে পড়ে আছে পুরো জীবন’-বলছিলেন নিজেকে আঙ্কেল রিশা নামে পরিচয় দেয়া ৭০-এর কাছাকাছি বয়সী এক ব্যক্তি।

রুশ সৈন্যরা কিন্তু বুচা ছেড়ে যাওয়ার সময় মোটেও মায়া-দয়া দেখায়নি। ইউক্রেনীয় বাহিনীর সৈন্যরা যখন শহরটিতে প্রবেশ করে তখন সেখানকার সড়কে অন্তত ২০ জনের মৃতদেহ পড়ে ছিল। অনেক মরদেহের হাত ছিল পেছন দিকে বাঁধা। শহরটির মেয়র জানান, তারা ২৮০ জনের লাশ জড়ো করে গণকবর দিয়েছেন।

রুশ বাহিনী আসার পরও যে অল্প কিছু বেসামরিক মানুষ শহরটিতে ছিলেন – তারা রুশ সৈন্যদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। ক্রুশ্চেভ আমলের তৈরি ফ্ল্যাটের বাইরে বসে তারা কাঠ পুড়িয়ে রান্না করতেন। কারণ তাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেয়া হয়েছিল।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.