দেশের শ্রম আইনে এখনো নারী–পুরুষ বৈষম্য আছে: বিশ্বব্যাংক

আইনি বৈষম্যের চেয়েও বড় বিষয় শ্রমবাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারীদের চ্যালেঞ্জ: সায়েমা হক

দেশের বিদ্যমান শ্রম আইনে (২০০৬) নারী–পুরুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। আইনে একই কাজের জন্য নারী–পুরুষের সমান মজুরি বাধ্যতামূলক করা হয়নি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ‘উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

শ্রম আইনে বলা হয়েছে, যেসব শিল্প–কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে হয়, সেখানে নারীদের নিয়োগ দেওয়া যাবে না (ধারা ৮৭, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬)। অর্থাৎ বাংলাদেশে পূর্ণ বয়স্ক নারীদেরও কিশোর–কিশোরীদের মতো বিবেচনা করা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, নারীরা কারখানায় রাতের পালায় কাজ করতে পারলেও সে জন্য তাদের কাছ থেকে লিখিত সম্মতি নেওয়া হয়, যেটা পুরুষের কাছ থেকে নেওয়া হয় না। এই প্রসঙ্গে আইএলওর পরামর্শ হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা রাখা হলে তা কেবল মাতৃত্বকালীন সুরক্ষার বিবেচনায় রাখা হোক, সমাজে নারীকে কী চোখে দেখা হয় বা নারীর সক্ষমতা আছে কি নেই, সেই বিবেচনা থেকে যেন আইন প্রণয়ন করা না হয়।

বিশ্বব্যাংকের মতে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকলে অর্থনীতির বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন, নারী শিক্ষা, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণে অনেক এগিয়ে গেলেও নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিত করতে যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সেসব সংস্কার বাস্তবায়নে পিছিয়ে আছে। সে জন্য প্রতিবেদন অনুসারে, নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৪ তম।

এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক বিদিশা অর্থসূচককে বলেন, আইন বা কাগজে-কলমে বৈষম্যের চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে শ্রমবাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারীদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়। এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে যখন নারীরা শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, তখন উচ্চপদে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরো এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়।

তিনি বলেন, এই চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে আমাদের পরিবার, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্টকে দায়িত্ব নিতে হবে। কেননা এসব প্রতিষ্ঠানগুলোই নারীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে।

তিনি আরও বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের সমান যোগ্যতা বা মেধা থাকা সত্বেও নারী কর্মীরা তাদের মেধার পুরো ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। কারণ তাকে সন্তান লালন-পালনসহ আরো অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা উচ্চপদে যেতে পারেন না। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকারকেও আরো অগ্রণী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে, দেশের পারিবারিক আইনেও নারী-পুরুষের বিভেদ আছে। অস্থাবর সম্পত্তি লাভে নারী-পুরেুষের সমান অধিকার থাকলেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে আছে। মুসলিম পারিবারিক আইনে সেই বিধান আছে। আর দেশের হিন্দু নারীরা পারবারিক সম্পত্তি এখনো পান না। হিন্দু পারবারিক আইনে এখনো প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা হয়নি। আর সামগ্রিকভাবে দেশের পারিবারিক আইনে গত ৫০ বছরে সংস্কার হয়নি।

বিশ্ব ব্যাংক বলছে, সম্পত্তিতে নারীর সমান উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে নারীর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিকশিত হবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেছে। যেমন, ২০০৬ সালের শ্রম আইনে, মাতৃত্বকালীন ছুটি ১৬ সপ্তাহ করা হয় এবং রাতে নারীদের কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে সরকার পারিবারিক সহিংসতা আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু এরপর, অর্থাৎ ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে আর কোনো সংস্কার হয়নি।

চলাচলের স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্র, বেতন, বিবাহ, অভিভাবকত্ব, উদ্যোক্তা, সম্পদ ও পেনশন -এই আটটি সূচকের ওপর ৩৫টি প্রশ্নের ভিত্তিতে এই স্কোর নির্ণয় করা হয়েছে। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৪তম; স্কোর ১০০-এর মধ্যে অর্ধেকের কম, ৪৯ দশমিক ৪। ২০২১ সালেও বাংলাদেশের স্কোর একই ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্কোর ছিল ৩৫। সেই হিসাবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আর্থিক সুযোগের সমতায় বাংলাদেশের নারীদের অবস্থানে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি।

বাংলাদেশের উন্নয়নে নারীদের ভূমিকার কথা অর্থনীতিবিদেরা বরাবরই প্রশংসা করেন। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীরা পুরুষের মতো সুযোগ পেলে শ্রমশক্তিতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়বে। এতে অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। আর নারী-পুরুষের আইনি সমতা থাকলে উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হয়।

৩৮ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে একমাত্র আফগানিস্তান। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের গড় স্কোর রেকর্ড করা হয়েছে ৬৩ দশমিক ৭। এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে নেপাল, তাদের স্কোর ৮০ দশমিক ৬। একমাত্র নারীদের চলাচলের স্বাধীনতা সূচকে শত ভাগ স্কোর করেছে বাংলাদেশ। আর কোনো সূচকে ৮০-এর বেশি স্কোর করতে পারেনি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৭৫। নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার সূচকে এই স্কোর পেয়েছে বাংলাদেশ।

সম্প্রতি এ বিষয়ে সরকারের কিছু সিদ্ধান্তে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ সবচেয়ে খারাপ করেছে অভিভাবকত্ব সূচকে। এই সূচকে স্কোর ছিল মাত্র ২০। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উন্নতি করতে পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে দেশের নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ শত ভাগ আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পিতৃত্বকালীন ছুটি বেতনসহ মঞ্জুর করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারী কর্মীদের চাকরি থেকে বরখাস্ত না করার জন্য বলেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৬টি দেশের নারীরা চাকরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। আর ৯৫টি দেশে একই কাজের জন্য পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পান নারীরা। তবে বাংলাদেশে ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে (জরিপের সময়) এ-সংক্রান্ত আইনের সংস্কার হয়নি।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.