বাড়ছে ব্যাংকঋণ, কমছে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমিয়ে এখন বাজেট ঘাটতির অর্থ জোগাতে ব্যাংক ঋণে ঝুঁকছে সরকার। ফলে একদিকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমছে। অন্যদিকে, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকগুলোর কাছে এখন পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিলেও বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে না। তবে সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (১ জুলাই থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকার ১৮ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ফলে ৩০ ডিসেম্বর শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা, যা গত ৩০ জুনে ছিল ২ লাখ ২ হাজার ১১৫ কোটি টাকা।

এই প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান মনসুর অর্থসূচককে বলেন, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিলে সরকারকে অনেক বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়। তাই সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে শর্ত আরোপ করা সঠিক হয়েছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো সমস্যা হবে না।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু ব্যাংকগুলোতে এখন পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে, ফলে ব্যাংকঋণ বাড়লেও এখনই কোন সমস্যা হবে না।

সরকার মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করতে চাচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাড়তি টাকার প্রয়োজন হচ্ছে। এ জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছে। তবে এ ঋণের চাপে যেন বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার কথাও জানান তিনি।

বাজেট ঘাটতি সরকার মেটাতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয় সরকার।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে অনুদান ছাড়া ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেটের আয়-ব্যয়ের বিশাল ঘাটতি পূরণে প্রধান ভরসাস্থল ব্যাংক খাত। এবারও ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর আগের অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্য থাকলেও এর বিপরীতে সরকার নিয়েছিল মাত্র ২৬ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।

সরকারের ঋণ নেওয়ার সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ৩৩ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ না নিয়ে উল্টো পরিশোধ করেছে। এসময় বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ করেছে ১৪ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে আলোচ্য সময়ে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা।

এদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। প্রথম পাঁচ মাসে নীট ঋণ নিয়েছে ১০ হাজার ২৫ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৩২ শতাংশ।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোতে ৪৪ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার বিক্রি হয়েছে। এসময় পুরনো সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর এ খাতে সরকারের নিট ঋণ এসেছে ১০ হাজার ২৫ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে নীট ঋণ ছিল ১৯ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। যা ওই অর্থবছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার সমপরিমাণ।

প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, একক মাস হিসেবে নভেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নীট ঋণ হয়েছে ৭০১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, গেল নভেম্বরে ব্যাংক খাতে মোট তরল সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৪৭ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। ওই সময়ে ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থ সংরক্ষণের (সিআরআর) দরকার ছিল ৬১ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। বিধিবদ্ধ তরল সম্পদ সংরক্ষণে (এসএলআর) দরকার ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণের পর ব্যাংকগুলোর হাতে ছিল ২ লাখ ১৮ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। যা উদ্বৃত্ত তারল্য হিসেবে ব্যাংক খাতে পরিচিত। গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।

এদিকে গত নভেম্বরে ব্যাংকে বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। ওই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এর আগের মাস অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

অর্থসূচক/মৃত্তিকা সাহা/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.